বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের লোগো

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম হচ্ছে উদ্ভিদের জাদুঘর যার অবস্থান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে। প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ এবং নতুন প্রজাতি নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন ১৬৯ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ২২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। গাছ ও বীজ থেকে শুরু করে লতাগুল্ম ও সাধারণ ঘাসের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশের একমাত্র উদ্ভিদ জাদুঘর।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৯৬৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সিম্পোজিয়ামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি হারবেরিয়াম স্থাপনের প্রস্তাব আনা হয়। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ ‘বোটানিক্যাল সোসাইটি অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম হয় ‘বোটানিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’। এ প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম নাম ধারণ করে ১৯৭৫ সালে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে ঢাকার মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান প্রাঙ্গণে শুরু হয় এর স্থায়ী ভবন নির্মাণের কাজ। পাঁচ বছর পর আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এ হারবেরিয়ামের কাজ শেষ হয়। একই বছর প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

কর্মকাণ্ড[সম্পাদনা]

বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্তকরণে হারবেরিয়াম কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের দুষ্প্রাপ্য প্রজাতি অনুসন্ধানেও হারবেরিয়ামের গবেষকরা কাজ করছেন।

নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ[সম্পাদনা]

গবেষকরা বাংলদেশে এ পর্যন্ত ১৬৯ প্রজাতির নতুন উদ্ভিদ শনাক্ত করেছেন। এরমধ্যে সম্প্রতি শনাক্ত করা ৪০ প্রজাতির উদ্ভিদের নাম অপ্রকাশিত আছে[১]। নতুন প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ‘ক্যানসকোরা অ্যান্ড্রগ্রাটিওয়েডিস’, মৌলভীবাজারের লাউয়াছাড়ায় ‘ডায়ানেলা ইনসিফোলিয়া’, শেরপুরের গজনি বনে ‘গনাটপাস বইভিনি’, চট্টগ্রামে অঞ্চলে ‘হিপটিস ব্রেভাইপস’, সুন্দরবন-বান্দরবান ও রাঙামাটি অঞ্চলে প্রাপ্ত ‘ওয়াল্টার’, সাভারে ‘অচনা পামিলিয়া’, রাঙামাটির ‘রাফিডোফোরা স্কট’, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডে ‘ম্যাকুলাতা’, রাঙামাটির ফারোয়াতে ‘কিকিউমাস হিসট্রিস চাকরে’। নতুন শনাক্তকৃত এসব প্রজাতির সন্ধান বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও দেশের বাহিরে এসব প্রজাতির সন্ধান আরো আগেই পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি না হওয়ায় হারবেরিয়ামের গবেষকরা এসব প্রজাতির কোন স্থানীয় নাম পাননি।

বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ চিহ্নিত[সম্পাদনা]

প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ২২৬ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে কাঠ ও ওষুধের জন্য ব্যবহূত ‘বান কামুলা’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জগন্নাথ হল ও ইশা খাঁ স্টাফ কোয়ার্টারের মধ্যবর্তী স্থানে প্রাপ্ত বিশেষ প্রজাতির ‘তালি’ নামক তাল গাছ, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে কাঠ ও চা বক্স তৈরির জন্য ব্যবহূত ‘ভূইয়া গাছ’, কাঠ বক্স ও আসবাবপত্র ব্যবহারের জন্য সিলেটের ‘বাতনা’ গাছ (ওয়াক ট্রি), চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওয়ারি গাব বা গুলুল, সুন্দরবন এলাকার গরসিংগিয়া (ম্যাংগ্রোব ট্রামপেট ট্রি), চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘বান বকুল’, সিলেট অঞ্চলের কাঠের জন্য ব্যবহূত ‘ফুল চম্বা’, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের ফল ও ফার্নিচারের জন্য ব্যবহূত ‘থেচু’ গাছ, সিলেট অঞ্চলের ওষুধি গাছ ‘কায়মুলা’ বা ‘কায়েংগলা’, একই অঞ্চলে শিল্প কারখানায় ব্যবহূত বিশেষ ধরনের বীজ ‘হলদু বারেলা’, রাঙামাটি এলাকায় ছাতা তৈরির জন্য বিশেষ পাতা ‘কুরুদ বা কুরুট্টি’। বিলুপ্তপ্রায় এসব উদ্ভিদের নমুনা ফুল, ফল, গাছের কাণ্ড, বীজ হারবেরিয়াম প্রেসে সংরক্ষণ করা হয়।

নমুনা সংরক্ষণ[সম্পাদনা]

তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখানে উদ্ভিদের নমুনা সংরক্ষণ করা হয়। বিশেষ যে কাগজের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয় তার নাম হারবেরিয়াম প্রেস। ১২ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চি দুটো কাঠের তক্তা জোড়া দিয়ে বানাতে হয় হারবেরিয়াম প্রেস। এই হারবেরিয়াম প্রেসের কাজ হল নমুনা উদ্ভিদের ফুল বা ফল যাই হোক না কেন সেগুলোকে চ্যাপ্টা বানানো। কার্ডবোর্ডের উপর নমুনাকে পাতলা টেপ বা সুতো দিয়ে আটকে প্রেসের ভেতরে বসিয়ে চাপ দিলে কাগজের ফালির মতো হয়ে যায় নমুনাটি। একে শুকানো সহজ। শুকনা নমুনাকে নিউজপ্রিন্টের কাগজে তৈরি খামের মত বা এনভেলপের মত করে তার ভেতরে রাখা হয়। নমুনা হতে পারে গাছের বাকল, শাখা, ফুল বা ফল সবকিছুই। যা কিছু প্রয়োজন তার সবই হতে পারে নমুনা। তবে এর সাইজ ১২ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চির প্রেসে আটতে হবে। এখানে রয়েছে একশ’ বছরেরও বেশি পুরনো হারবেরিয়াম সিট। সংরক্ষিত হারবেরিয়াম শিটের সংখ্যা এক লাখেরও ওপরে। স্পিরিট কালেকশনে রাখা হয় উদ্ভিদের ফল-মূল। এগুলোকে কাচের বোতলে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। উদ্ভিদের ড্রাই কালেকশনও আছে চারশ’র বেশি। সেই সাথে রাখা হয় বিজ্ঞানী কর্তৃক বর্ণিত উদ্ভিদের বিবরণনামা।প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির নাম অন্তর্ভুক্ত করে ‘রেড ডাটা বুক’ নামে একটি বই প্রকাশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ওষুধি গাছ নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ‘সার্ভে অব ফ্লোরা’ নামে আরেকটি বই। এ ছাড়া হারবেরিয়াম থেকে এ পর্যন্ত ২ শতাধিক গ্রন্থ ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "আমাদের উদ্ভিদ জাদুঘর - রাজধানী - The Daily Ittefaq"। ১২ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০১৭