মহামন্দা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯১০-৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাৎসরিক জিডিপি, মহামন্দার বছরসমূহের (১৯২৯-৩৯) (গোলাপী রং)।
১৯১০-৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার, মহামন্দার বছরসমূহের (১৯২৯-৩৯) (গোলাপী রং)।

মহামন্দা ১৯৩০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী সংগঠিত একটি মন্দা। এটি শুরু হয় ১৯২৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৩৯ এর দশকের শেষের দিকে।[১] এটি বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময় ব্যাপী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী একটি মন্দা। [২] একবিংশ শতাব্দীতে এ মহামন্দাকে বিশ্ব অর্থনীতির পতনের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[৩]

১৯২৯ সালে ৪ সেপ্টেম্বর স্টক বাজারে দরপতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মন্দা শুরু হয়। পরে ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবর এই খবর বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেটে ছড়িয়ে পরে, যা কালো মঙ্গলবার নামে পরিচিত। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রায় ১৫% হ্রাস পায়। কিছু অর্থনীতি ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝিতে কিছু পূর্বের অবস্থায় আসলেও অনেক দেশের অর্থনীতিতে মহামন্দার প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত ছিল।[৪]

ধনী ও দরিদ্র উভয় দেশসমূহে মহামন্দা বিধ্বংসী প্রভাব ছিল। ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ৫০% কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ২৫% বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাড়ায় ৩৩%।[৫]

পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব তীব্র ছিল, বিশেষ করে যেসব শহর ভারী শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। অনেক দেশে নির্মাণকাজ একরকম বন্ধই ছিল। কৃষক সম্প্রদায় ও গ্রাম্য এলাকাসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল কারণ শস্যের মূল্য ৬০% নেমে এসেছিল।[৬][৭][৮] গুটিকয়েক চাকরির উৎসে অত্যধিক চাহিদার কারণে প্রাথমিক শিল্প, যেমন খনির কাজে চাপ সৃষ্টি হয়।[৯]

সূত্রপাত[সম্পাদনা]

মন্দার পরে স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে একটি বিরাট ভিড় জড়ো হয় (১৯২৯)।

অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদেরা ১৯২৯ সালের ২৯ আগস্ট কালো মঙ্গলবার নামে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজি বাজারের হঠাৎ দরপতনকে মহামন্দার সূত্রপাত বলে অভিহিত করেন।[১০] কয়েকজন মনে করেন এই দরপতন ছিল মহামন্দার উপসর্গ, কারণ নয়।[১১]

১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ধসের পরও অর্থনীতিবিদগণ অল্প সময় আশাবাদী ছিলেন। জন ডি. রকফেলার বলেন, "এই সময়ে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমার জীবনের ৯৩ বছরে মন্দা এসেছে এবং চলেও গেছে। উন্নতি সবসময় ফিরে এসেছে এবং আবার আসবে।"[১২] ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে পুঁজি বাজারের সূচক উপরে উঠেছিল এবং ১৯২৯ সালের শুরুর দিকে এপ্রিল মাসে তা পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। ১৯২৯ সালে সেপ্টেম্বরের সর্বোচ্চ সূচকের তুলনায় তা ৩০% কম ছিল।[১৩]

সরকার ও ব্যবসায়ীরা ১৯৩০ এর দশকের প্রথমার্ধে পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় অধিক সময় একসাথে অবস্থান করে। অন্যদিকে, যেসব পূর্ববর্তী বছরে পুঁজি বাজারে লোকসান হওয়া ভোক্তারা ১০% ব্যয় কমিয়ে আনে। ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মারাত্মক খরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমির কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দেয়।[১৪]

কারণ[সম্পাদনা]

মহামন্দার দুটি ধ্রুপদী তত্ত্ব হল কেইনেসীয় (চাহিদা চালিত) এবং অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা। এছাড়া বিভিন্ন প্রচলিত তত্ত্ব কেইনেসীয় বা অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকে বর্জন করে থাকে। চাহিদা চালিত তত্ত্বে বলা হয় বাজারের উপর আস্থা হারানোর ফলে ভোগের পরিমাণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয় কমে যায়। একবার মূল্যহ্রাস পাওয়ার ফলে অনেক মানুষ ধারণা করে নতুন করে বাজারে বিনিয়োগ না করে তারা তাদের ক্ষতি পোষিয়ে

নিতে পারবে। টাকা বিনিয়োগ না করায় মূল্যহ্রাস পেলে তারা লাভবান হয় এবং চাহিদা কমায় স্বল্পমূল্যে অধিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন মহামন্দা সাধারণ দরপতন হিসেবে শুরু হয় কিন্তু অর্থ সরবরাহ সঙ্কুচিত হতে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং এই সাধারণ দরপতন মহামন্দার রূপ ধারণ করে।

অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসবেত্তাগণ সমানভাবে বিভক্ত এবং তারা মনে করেন প্রথাগত আর্থিক ব্যাখ্যা অনুসারে মহামন্দার প্রাথমিক কারণ আর্থিক খাতের সাথে সম্পর্কিত, বা প্রথাগত কেইনেসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে মহামন্দার প্রাথমিক কারণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যয়, বিশেষ করে বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়ের পতন।[১৫] বর্তমানে এই বিতর্ক তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ ঋণ সংকোচন তত্ত্বের কিছু মূলধারার সমর্থন পাওয়া যায় এবং মিল্টন ফ্রিড্‌ম্যানআনা শোয়ার্ট্‌জ এর আর্থিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি হাইপোথিসিসে অ-আর্থিক ব্যাখ্যাও যোগ করা হয়েছে।

এই ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এর আর্থিক সংকোচন এবং ব্যাংকিং পতন রোধ করা উচিত ছিল। যদি ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম তা করতে পারত তাহলে মন্দার প্রভাব আরো কম তীব্র এবং স্বল্পস্থায়ী হত।[১৫]

প্রভাব[সম্পাদনা]

বেশির ভাগ দেশেই ত্রাণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এবং অনেক দেশ রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের কাছে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে, বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত নাৎসি জার্মানিলিউফাউন্ডল্যান্ডের কর্তৃত্বের ফলে স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র ছেড়ে দিতে হয়।

সাহিত্য[সম্পাদনা]

মহামন্দা অনেক সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। কারণ সাহিত্যিকগণ এমন একটি যুগকে উপস্থাপন করে যেখানে অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ ছিল। এই বিষয়ের উপর রচিত সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রসিদ্ধ উপন্যাস হল জন স্টাইন্‌বেক্‌ রচিত ১৯৩৯ সালের দ্য গ্রেপ্‌স অফ র‍্যাথ। বইটি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। বইটিতে বর্গাচাষী এক পরিবারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যারা খরা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কৃষিজাত শিল্পের পরিবর্তনের ফলে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। স্টেইনব্যাকের অফ মাইস অ্যান্ড মেন মহামন্দা সময়কালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসিকা। এছাড়া হার্পার লির টু কিল আ মকিংবার্ড মহামন্দার প্রেক্ষাপটে রচিত। মার্গারেট অ্যাটউড রচিত বুকার পুরস্কার বিজয়ী দ্য ব্লাইন্ড অ্যাসাসিনও কিছুটা মহামন্দার প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে সুবিধাভোগী সমাজের এক নারী এক মাক্সবাদী বিপ্লবীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।[১৬][১৭][১৮][১৯]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের কারনে-অকারনে যেমন মমহামারি,বন্যা,খরা ও দেশের অপরিকল্পিত ব্যাবসায় কারনে হতে পারে

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. John A. Garraty (1986), The Great Depression।
  2. Charles Duhigg (March 23, 2008), "Depression, You Say? Check Those Safety Nets", The New York Times.
  3. Eichengreen, Barry (2014), Hall of Mirrors: The Great Depression, The Great Recession, and the Uses-and Misuses-of History।
  4. Garraty (1986), Great Depression, ch1
  5. Frank, Robert H.; Bernanke, Ben S. (২০০৭)। Principles of Macroeconomics (3rd ed.) (ইংরেজি ভাষায়)। Boston: McGraw-Hill/Irwin। পৃষ্ঠা 98। আইএসবিএন 0-07-319397-6 
  6. "Commodity Data" (ইংরেজি ভাষায়)। US Bureau of Labor Statistics। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  7. Cochrane, Willard W. (১৯৫৮)। "Farm Prices, Myth and Reality" (ইংরেজি ভাষায়): 15। 
  8. "World Economic Survey 1932–33"। League of Nations (ইংরেজি ভাষায়): 43। 
  9. Mitchell, Broadus (এপ্রিল ৩০, ১৯৭৭)। The Depression Decade: From New Era Through New Deal, 1929-41: From New Era Through New Deal, 1929-41 (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। পৃষ্ঠা 480। আইএসবিএন 9780873320979 
  10. Great Depression, Encyclopædia Britannica
  11. "Economics focus: The Great Depression" (ইংরেজি ভাষায়)। The Economist। 
  12. Schultz, Stanley K. (১৯৯৯)। "Crashing Hopes: The Great Depression"American History 102: Civil War to the Present (ইংরেজি ভাষায়)। University of Wisconsin–Madison। ২০০৮-০৩-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  13. "1998/99 Prognosis Based Upon 1929 Market Autopsy" (ইংরেজি ভাষায়)। Gold Eagle। মে ১৭, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  14. "Drought: A Paleo Perspective – 20th Century Drought" (ইংরেজি ভাষায়)। National Climatic Data Center। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  15. Whaples, Robert (March 1995), Where Is There Consensus Among American Economic Historians? The Results of a Survey on Forty Propositions., Journal of Economic History, Vol. 55, No. 1, p. 150
  16. Taylor, David (2009), Soul of a People: The WPA Writers' Project Uncovers Depression America
  17. Mangione, Jerre (1996), The Dream and the Deal: The Federal Writers' Project, 1935–1943।
  18. Hirsch, Jerrold (2006), Portrait of America: A Cultural History of the Federal Writers' Project।
  19. Morgan, Stacy I. (2004), Rethinking Social Realism: African American art and literature, 1930–1953, p. 244.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]