পূর্ব রণাঙ্গন (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পূর্ব রণাঙ্গন
মূল যুদ্ধ: ১ম বিশ্বযুদ্ধ

উপরে বাঁ দিক থেকে (ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত): কার্পেথিয়ান পর্বতমালায় অবস্থানরত সৈন্যগণ, ১৯১৫; কিয়েভ নগরীতে জার্মান সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চ, ১৯১৮; রুশ রণতরী "স্লাভা", অক্টোবর, ১৯১৭; রুশ পদাতিক বাহিনী, ১৯১৪; রোমানীয় পদাতিক বাহিনী
তারিখ১৭ আগস্ট, ১৯১৪ - ৩ মার্চ, ১৯১৮
৩ বছর, ৬ মাস ও ২ সপ্তাহ
অবস্থান
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ
ফলাফল

কেন্দ্রীয় শক্তির বিজয়

  • রুশ সাম্রাজ্যের পতন, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সূত্রপাত
  • ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি (ইউক্রেন), ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি (রাশিয়া), বুখারেস্ট চুক্তি
  • পশ্চিম রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয়ে এসকল চুক্তির অবসান
বিবাদমান পক্ষ
 জার্মান সাম্রাজ্য
 অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি
 বুলগেরিয়া (১৯১৬-১৭)
উসমানীয় সাম্রাজ্য (১৯১৬-১৭)

রুশ সাম্রাজ্য (১৯১৪–১৭)
রুশ প্রজাতন্ত্র (১৯১৭)
রোমানিয়া সাম্রাজ্য (১৯১৬-১৭)
বেলজিয়াম (১৯১৫-১৮)
 ব্রিটিশ সাম্রাজ্য (১৯১৬-১৭)
ফ্রান্স (১৯১৬-১৮)


সোভিয়েত রাশিয়া (১৯১৮)
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
  • পল ফন হিন্ডেনবার্গ
  • এরিখ লুডেনডর্ফ
  • যুবরাজ লিওপোল্ড অব ব্যাভারিয়া
  • ম্যাক্স হফম্যান
  • কনরাড ফন হোজেনডর্ফ
  • আর্থার আর্জ ফন স্ট্রসেনবার্গ
  • নিকোলা জেকভ
  • রুশ সম্রাট ২য় নিকোলাস
  • গ্র্যান্ড ডিউক নিকোলাস নিকোলিভিচ (১৮৫৬-১৯২৯)
  • আলেক্সেই ব্রুসিলভ
  • লাভ্‌র কর্নিলভ
  • মিখাইল আলেক্সেয়েভ
  • আলেক্সান্ডার কেরেনস্কি
  • কনস্টান্টিন প্রেজান

নিকোলাই ক্রিলেঙ্কো
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
  • ১৪,৬৮,৮১১:
    • ১,৭৩,৮৫৮ জন নিহত
    • ১১,৫১,১৫৩ জন আহত
    • ১,৪৩,৮১৮ জন বন্দী
    [১][২][৩]
  • ৪৩,৭৭,০০০:[৪][৫]
  • ৭,৩০,০০০ জন নিহত
  • ২১,৭২,০০০ জন আহত
  • ১৪,৭৯,০০০ জন নিখোঁজ বা বন্দী
  • ৪৫,০০০:[৬][৭]
  • ১০,০০০ জন বন্দী[৮]
  • ৩০,২৫০[৯][১০]

মোট:
৫৯,০০,০০০ হতাহত
  • ৯৩,৪৭,০০০:
    ২২,৫৪,৩৬৯ জন নিহত
  • ৩৭,৪৯,০০০ জন আহত
  • ৩৩,৪৩,০০০ জন বন্দী[১১][nb ১]
  • ৫,৩৫,৭০০:[১৩]
    ৩,৩৫,৭০৬ জন নিহত
    ১,২০,০০০ জন আহত
    ৮০,০০০ বন্দী

মোট:
~৯৯,০০,০০০ হতাহত
হতাহত বেসামরিক নাগরিক:
২০,০০,০০০+
রাশিয়া:
সামরিক কার্যকলাপে ৪,১০,০০০ জনের মৃত্যু
যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ৭,৩০,০০০ জনের মৃত্যু[১৪]
রোমানিয়া সাম্রাজ্য:
সামরিক কার্যকলাপে ১,৩০,০০০ জনের মৃত্যু
যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ২,০০,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু[১৫]
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি:
সামরিক কার্যকলাপে ১,২০,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু
যুদ্ধ-সংক্রান্ত কারণে ৪,৬৭,০০০ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু[১৬]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন (জার্মান: Ostfront, রুশ: Восточный фронт, Vostochnıy front) ছিল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল, চূড়ান্ত পর্যায়ে যার বিস্তৃতি ছিল একপ্রান্তে রুশ সাম্রাজ্য ও রোমানিয়ার মধ্যকার সীমান্ত, এবং অন্য প্রান্তে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া, অটোমান সাম্রাজ্য এবং জার্মান সাম্রাজ্য। উত্তরে বাল্টিক সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত এ রণাঙ্গনের বিস্তৃতি ছিল, যা প্রায় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ জুড়ে এমনকি মধ্য ইউরোপ জুড়েও সংঘটিত হয়েছিল। এর সাথে ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনের তুলনা চলে, যার অবস্থান ছিল বেলজিয়ামফ্রান্স জুড়ে।

পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের সূচনা হয় রাশিয়ান ফৌজের পূর্ব প্রাশিয়া আক্রমণের সাথে সাথে। একই সঙ্গে রুশ বাহিনী উত্তরে ও দক্ষিণে যথাক্রমে জার্মান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রাশিয়া এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের গ্যালিসিয়া প্রদেশে দ্বিমুখী আক্রমণ চালায়। উত্তরের আগ্রাসন জার্মানরা প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও গ্যালিসিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এর ফলে জার্মানি বাধ্য হয় তার সামরিক শক্তির এক বিরাট অংশ পশ্চিম ইউরোপ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানান্তর করতে। এর ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে এবং ১৯১৫ সাল নাগাদ সম্মিলিত জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আগ্রাসনের সামনে রাশিয়া, পোল্যান্ড ও গ্যালিসিয়া থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জার নিকোলাস স্বয়ং সেনাবাহিনীর ভার নিজের হাতে তুলে নেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটে না।

পরবর্তী বছর ১৯১৬ এই যুদ্ধের একটি অন্যতম ঘটনাবহুল সময়। এই বছর রাশিয়া রুশ-তুর্কি ফ্রন্টে বড়সড় সাফল্য অর্জন করে। অন্যদিকে রুশ জেনারেল ব্রুসিলভ পুনরায় গ্যালিসিয়া প্রদেশে সফল অভিযান চালান, যা ইতিহাসে ব্রুসিলভ অফেন্সিভ নামে বিখ্যাত। এছাড়াও নারাচ হ্রদ, বারানাভিচি (বর্তমান বেলারুশ এর অন্তর্গত) ইত্যাদি এলাকায় রাশিয়া কেন্দ্রীয় শক্তির ওপর বিরাট আক্রমণ চালায়। এই অভিযানগুলি সামরিক দিক দিয়ে সফল না হলেও তা পশ্চিম রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।

১৯১৬ সালের অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা রোমানিয়ার যুদ্ধে যোগদান। এবছর ই আগস্ট মাসে রোমানিয়ার সেনাবাহিনী ট্রানসিলভ্যানিয়া প্রদেশে আক্রমণ চালায়। যদিও রোমানিয়ার সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী, কারণ এর পরই দক্ষিণ দিক থেকে বুলগেরিয়ার আক্রমণ এবং জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান প্রতিরোধ তথা পুনরাক্রমণে রোমানিয়া পর্যুদস্ত হয়।

১৯১০ সালে, রুশ সেনাপতি ইউরি দানিলভ তাঁর "পরিকল্পনা ১৯" বাস্তবায়ন করেন, যে পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি রুশ বাহিনী জার্মান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রুশিয়ায় হামলা চালায়। এ পরিকল্পনাটির সমালোচনা করা হয় কেননা তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্যের তুলনায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য অধিক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক ছিল। তাই পরিকল্পনা পাল্টে রুশগণ দুটি বাহিনীকে পূর্ব প্রুশিয়ায় ও অপর দুটিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যারা তাদের গ্যালিসিয়া রাজ্য থেকে রাশিয়াকে আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছিল। যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম কয়েক মাসে রুশ রাজকীয় সেনাবাহিনী পূর্ব প্রুশিয়ায় আক্রমণ ও দখল করার ব্যপক প্রয়াস চালায়, তবে প্রাথমিক কিছু সাফল্যের পর "ট্যানেনবার্গের যুদ্ধে" জার্মান বাহিনী তাদেরকে রুখে দেয়। একই সময়ে দক্ষিণে, রুশ বাহিনী "গ্যালিসিয়ার যুদ্ধে" অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীকে পরাজিত করে গ্যালিসিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে কংগ্রেস-পোল্যান্ডে জার্মান বাহিনী আক্রমণ চালায়, কিন্তু ওয়ারস' দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৯১৫ সালে জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য একত্রে রুশ সাম্রাজ্যের ওপর হামলা চালায় এবং গ্যালিসিয়া ও পোল্যান্ডে রুশ বাহিনীর ওপর তুমুল আঘাত হানে, এতে রুশ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। রুশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক গ্র্যান্ড ডিউক নিকোলাসকে বরখাস্ত করা হয় এবং তাঁর স্থলে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নেন স্বয়ং সম্রাট ("জার")।[১৭] ১৯১৬ সালে জার্মানদের বিরুদ্ধে রুশ বাহিনী কয়েকটি ব্যর্থ আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে অন্যতম "নারোখ হ্রদ আক্রমণ" এবং "বারানোভিচি আক্রমণ"। তবে রুশ জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভ অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়দের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালান, যা "ব্রুসিলভ অভিযান" নামে পরিচিত, এ আক্রমণ অভিযানে রুশ সেনাবাহিনী বিস্তর ভূখণ্ড দখল করে নেয়।[১৮][১৯][২০]

১৯১৬ সালের আগস্ট মাসে রুশদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় রোমানিয়া সাম্রাজ্য। রোমানিয়ার সাহায্যের বিনিময়ে রুশরা তাদেরকে ট্রান্সিলভানিয়া অঞ্চলটি (যা তৎকালীন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল), হস্তান্তর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। রোমানীয় সেনাবাহিনী ট্রান্সিলভানিয়া আক্রমণ করে এবং প্রাথমিকভাবে সাফল্যের দেখা পায়। তবে জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের মিলিত আক্রমণে ও একই সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে বুলগেরিয়ার আক্রমণে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এসময়ে রাশিয়ায় শুরু হয় বিদ্রোহ (ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, ১৯১৭), যার অন্যতম কারণ ছিল যুদ্ধের কারণে জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ। জার ২য় নিকোলাস বাধ্য হন সিংহাসন ত্যাগ করতে, এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয় নবগঠিত রুশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রথম নেতা হন জর্জি লেভোভ, শেষ পর্যন্ত তাঁকেও প্রতিস্থাপন করেন আলেক্সান্ডার কেরেনস্কি।

এই নবগঠিত রুশ প্রজাতন্ত্র রোমানিয়া ও তাদের পূর্বের মিত্রদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে বলশেভিকগণ কর্তৃক সংগঠিত "অক্টোবর বিপ্লবে" (১৯১৭) রুশ প্রজাতন্ত্রের পতন হয়। কেরেনস্কির নেতৃত্বে রুশ বাহিনী পরিচালনা করেছিল "জুলাই হামলা অভিযান" যা চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং রুশ বাহিনী পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। রাশিয়ার বলশেভিক দল কর্তৃক নবগঠিত "সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সরকার" কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করে, যা "ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি" নামে পরিচিত, এ চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া যুদ্ধ থেকে তাদের সমস্ত বাহিনী প্রত্যাহার করে এবং দখলকৃত বহু অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়। ১৯১৮ সালে রোমানিয়া সাম্রাজ্যও আত্মসমর্পণ করে ও অনুরূপ শান্তিচুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয়, যা "বুখারেস্ট চুক্তি" হিসেবে জ্ঞাত। তবে, ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয় ও আত্মসমর্পণে এই দু'টি চুক্তিই অকার্যকর হয়ে যায়।

ভৌগোলিক অবস্থান[সম্পাদনা]

পূর্বের রণাঙ্গনটি ছিল পশ্চিমের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর। রণাঙ্গনটির সীমানা বলা যায়- পশ্চিমে বাল্টিক সাগর, পূর্বে মিন্‌স্ক নগরী, উত্তরে সেন্ট পিটার্সবার্গ নগরী এবং দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর, যার উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ১৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি। এই রণাঙ্গনের বিস্তৃতির প্রভাব পড়ে এতে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের প্রকৃতির ওপর।

১ম বিশ্বযুদ্ধের পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ সংঘটিত হয় মূলতঃ এর পরিখা ও সুড়ঙ্গসমূহে, তবে পূর্বের যুদ্ধসমূহ ছিল অনেকটা গতিশীল এবং এসমস্ত যুদ্ধে সুড়ঙ্গ বা পরিখার ব্যবহার দেখা যায় না বললেই চলে। এ রণাঙ্গন বিস্তর অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত হওয়ায় এর সেনাবাহিনীসমূহকে ছড়িয়ে পড়তে হয় এবং একস্থানে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক সৈন্যসমাগম ঘটে থাকে। এর বাহিনীসমূহের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দূর্বল, এ কারণে তাদের সম্মুখ সারির রক্ষাব্যূহ শত্রু কর্তৃক ছিন্ন হলে এসমস্ত বিচ্ছিন্ন অংশে অতিরিক্ত সৈন্য যোগান দেয়ার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।

প্রচারণা ও রটনা[সম্পাদনা]

প্রচারণা ছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধের একটি অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি। রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হত স্বরাষ্ট্রকে মহিমান্বিত করা ও প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে অশুভ শত্রুরূপে প্রকাশ করার লক্ষ্যে। এসমস্ত প্রচার ব্যবস্থা রূপকথার বিভিন্ন উপমা ও নিজ রাষ্ট্রের মহান ইতিহাসকে বিভিন্ন চিত্রায়িত রূপ দিয়ে তাদের মতামতকে জনসমক্ষে তুলে ধরত। পূর্ব রণাঙ্গনে এসম প্রচার মাধ্যমের মধ্যে ছিল অপেরা, ছায়াছবি, গোয়েন্দা কাহিনী, কল্পকাহিনী, মঞ্চনাট্য, যুদ্ধ-উপন্যাস, শিল্পকর্ম ইত্যাদি। একেক রাষ্ট্রে এসমস্ত প্রচারকার্যের পরিমাণ একেক রকম ছিল। এসমস্ত প্রচারকাজে নিয়োজিত থাকত বিভিন্ন গোষ্ঠী, এবং প্রতি রাষ্ট্রেই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে তা পরিচালিত হত। প্রধানত রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমগুলোই প্রচারণা চালিয়ে থাকত, তবে অন্যান্য গোষ্ঠী, যেমন যুদ্ধ-বিরোধীরাও তাদের প্রচার কাজ পরিচালনা করত।[২১]

যুদ্ধে অবতীর্ণ রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধ-পূর্ব পরিস্থিতি[সম্পাদনা]

জার্মানি[সম্পাদনা]

যুদ্ধ আরম্ভের প্রাক্কালে, জার্মানদের রণকৌশল সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তাদের "শ্লাইফেন" (Schlieffen) পরিকল্পনার ওপর। রুশ-ফরাসি চুক্তির কারণে জার্মানি জানত যে, এদের একটির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া মানে অন্যটিকেও যুদ্ধে জড়ানো, যার অর্থ, তাদের পূর্ব ও পশ্চিমে একইসাথে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। সুতরাং, জার্মান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আলফ্রেড ফন শ্লাইফেন পরিকল্পনা করেন পশ্চিমে এক প্রচণ্ড ও ঝড়োগতির আক্রমণ পরিচালনা করে দ্রুত ফ্রান্সকে পরাস্ত করতে হবে, যাতে বিজয় শেষে জার্মানি পূর্ব-প্রান্তরে রাশিয়ার প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে। ইতিপূর্বে রুশ-জাপানি যুদ্ধে রাশিয়া ব্যপক পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল, তাছাড়া তাদের রেল-যোগাযোগ তখনও উন্নত ছিল না। তাই জেনারেল ফন শ্লাইফেন ভেবেছিলেন এই মুহূর্তে রাশিয়া জার্মানিকে আক্রমণ করার মত প্রস্তুতি নিতে পারবে না।

তদুপরি, জার্মান নৌবাহিনী ধারণা করেছিল রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকলে তারা ব্রিটেনকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে, যদিও প্রুশিয়ান ফিল্ড মার্শাল ফন মল্ট্‌কে জানতেন যে তা সম্ভব নয়।

রোমানিয়া[সম্পাদনা]

"বুখারেস্ট চুক্তি" অনুযায়ী রোমানিয়া সাম্রাজ্যের সীমান্তের পরিবর্ধন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পূর্বেই রোমানিয়া সাম্রাজ্য অংশ নেয় ২য় বলকান যুদ্ধে, তাদের অবস্থান ছিল সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, গ্রীস ও উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পক্ষে এবং বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে। ১৯১৩ সালের ১০ই আগস্ট বুখারেস্ট চুক্তি (১৯১৩) সাক্ষরের মাধ্যমে বলকান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং এই চুক্তি অনুযায়ী রোমানিয়া ৬,৯৬০ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডের অধিকার পায়।[২২] যদিও রোমানিয়া ছিল একটি সামরিক রাষ্ট্র, তবুও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। এর প্রধান কারণ- অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি শাসিত ট্রান্সিলভানিয়া ও বুকোভিনা এবং রাশিয়ার শাসনাধীন বেসারাবিয়া- এই দুই অঞ্চলই দখল করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। রোমানিয়ার পক্ষাবলম্বনে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভূমিকা ছিল ব্যপক। রোমানিয়ার রাজা ১ম ক্যারল, হোহেনজোলার্ন-সিগম্যারিঙ্গেন বংশের তথা জার্মান বংশদ্ভূত হওয়ায় তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল জার্মানদের প্রতি, অপরদিকে রোমানিয়ার জনগণ অর্থোডক্স খ্রীষ্টান হওয়াতে এবং তাদের ভাষা লাতিন-ভিত্তিক হওয়াতে তাদের সমর্থন ছিল ফ্রান্সের প্রতি। রাজা ১ম ক্যারল ১৯১৪ সালে মৃত্যুবরণ না করলে হয়তো তিনি জার্মানদের হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণে এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির প্রতি রোমানীয় জনগণ বীতশ্রদ্ধ হওয়ায় জনমত ও রাজনৈতিক অবস্থান অনুসারে রোমানিয়া রাশিয়া ও ফ্রান্সের পক্ষ নেয়। তদুপরি বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে রোমানিয়ার যুদ্ধকে ফ্রান্সের সমর্থন ও বুখারেস্ট চুক্তির শর্তাবলীর কারণে রোমানিয়া শেষ পর্যন্ত "এন্টেন্ট" বা রুশ-ফরাসি মিত্রপক্ষে যোগদান করে। তাছাড়া ১৯১৪ সালের ১৭ই জুন, রুশ সাম্রাজ্যের জার রোমানিয়ার কনস্টান্টা নগরীতে ভ্রমণে আসেন এবং তাঁর এই যাত্রা রুশ সাম্রাজ্য ও রোমানিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।[২৩] এতদসত্ত্বেও রোমানিয়ার রাজা ১ম ফার্ডিনান্ড যুদ্ধের শুরুতে নিরপেক্ষ থাকেন, এবং যুধ্যমান দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে রোমানিয়ার জন্যে লাভজনক একটি সমাধান উত্থাপনের আশা করেন। "এন্টেন্টের" সাথে রোমানিয়া সাম্রাজ্যের সমঝোতার ফলশ্রুতিই হল "বুখারেস্টের চুক্তি (১৯১৬)", যার শর্তমতে রোমানিয়া "এন্টেন্টের" পক্ষে (রুশ-ফরাসি মিত্রবাহিনী পক্ষে) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এর বিনিময়ে রোমানিয়াকে প্রতিপক্ষ অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির কতিপয় অঞ্চল হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, এ অঞ্চলসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল: ট্রান্সিলভানিয়া, ক্রিসানা, মারামুরেস, বানাট এবং বুকোভিনার অধিকাংশ। ইতিহাসবিদ জন কীগানের মতে, চুক্তিতে উল্লেখ করা এসমস্ত প্রতিশ্রুতি মোটেই সুস্পষ্ট ছিল না, বরং রাশিয়া ও ফ্রান্স গোপনে যুদ্ধশেষে এই চুক্তির শর্তসমূহ ভঙ্গ করার পরিকল্পনা করে।[২৪]

রাশিয়া[সম্পাদনা]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের তাত্ক্ষণিক কারণ ছিল ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে এর কূটনীতিবিদ ও সেনাপতিদের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ। ১৯১৪ পূর্ববর্তী কয়েক দশকে, ইউরোপে ঘটে যাওয়া একের পর এক কূটনৈতিক সংঘর্ষ ও বিবাদসমূহের ফলশ্রুতিতে ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে সমগ্র ইউরোপ ব্যপী এক অবিশ্বাস, সন্দেহ ও যুদ্ধভাবাপন্ন অবস্থা বিরাজ করে, যা "জুলাই বিপর্যয়" (July crisis) নামে ইতিহাসে পরিচিত। এই জুলাই বিপর্যয়ের আলোচনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রাশিয়ার অবস্থান বোধগম্য হবার জন্যে অপরিহার্য। ইতিহাসবিদ ডি.সি. লিভেনের মতে, রাশিয়ার সামরিক শক্তিতে ছিল দুর্ধর্ষ এবং তাদের যেকোন কূটনৈতিক চাল বাস্তবায়ন করার জন্যে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা তাদের ছিল। ১৮৭০-১৯১৪ সালের মধ্যে ইউরোপে চারটি প্রধান পরাশক্তি ছিল রাশিয়া, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্স, যাদের কেউই সামরিক শক্তিতে একে অপরের কম ছিল না। তবে রাশিয়ার যুদ্ধে গমনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এর অর্থনৈতিক ধ্বস।[২৫] ১৮৬৬-৭৭ সাল এবং ১৮৭১-৭৫ সালের মধ্যে সামরিক ক্ষাতে রাশিয়ার খরচ বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ, এতে করে ইউরোপে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে।[২৬] এসময় রাশিয়ার অবকাঠামো ছিল অনুন্নত এবং তাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় রাশিয়াকে এর কাঠামোগত উন্নয়ন খাতে অধিক পরিমাণে অর্থব্যয় করতে হয়। তদুপরি, প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়ভার উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে, যার ফলাফলস্বরূপ তারা অর্থনৈতিক ধ্বসের সম্মুখীন হয়। এসমস্ত কারণে রুশ জনগণ ব্যপক চাপের মুখে পড়ে এবং একই সাথে তাদের সামরিক খাতের ব্যয়ভারও হুমকির সম্মুখীন হয়।[২৭] তাই, ইউরোপীয় যুদ্ধক্ষেত্রের টানাপোড়নে রাশিয়ার টিকে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় বৈদেশিক চুক্তিসমূহের উপর নির্ভরশীলতা। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সাহায্যে এগিয়ে আসে ফ্রান্স, তারা রাশিয়ার শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নে ব্যপক ভূমিকা রাখে। রুশ-ফরাসি মৈত্রীচুক্তির ফলে রাশিয়া তাদের সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এবং ক্রমশঃ শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকা জার্মান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে রুশ-ফরাসি চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯১৪ সালে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল জার্মানি। তথাপি, ১৮৯০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার গৃহীত বৈদেশিক-সম্পর্ক নীতি ছিল যুদ্ধের অপর একটি নির্ধারক।

রুশ প্রচারণা[সম্পাদনা]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ায় অংকিত একটি ব্যঙ্গচিত্র: চিত্রে দেখা যাচ্ছে, জার্মানির কাইজার ২য় উইলহেম, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সম্রাট ১ম ফ্রাঞ্জ জোসেফ এবং উসমানীয় সম্রাট ৫ম মেহমেদকে। উপরে: "যদি আমরা শুধু উপরে পৌঁছুতে পারি- সবই আমাদের হবে!" নিচে: "তবে তোমাদের সাহায্য করা যাক!"

রাশিয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াকে ন্যয়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হিসেবে জনমনে স্থান দেয়ার জন্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রসমূহকে শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা হতে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল জার্মানির "অপরাজেয়" সামরিক বাহিনীর যে ধারণা জনমনে ছিল, তা মুছে ফেলা, যাতে সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। রুশ প্রচারণায় জার্মানদের প্রায়ই দেখানো হত সভ্য জাতি কিন্তু অসভ্য ও "অমানুষিক" গুনাবলি সম্পন্ন হিসেবে। জার্মান যুদ্ধবন্দী শিবিরে রুশ সেনাদের তোলা আলোকচিত্রসমূহকেও রুশ গণমাধ্যম অপব্যবহার করে থাকে, যাতে "অমানুষ" জার্মানদের বিরুদ্ধে রুশ সেনা ও জনগণের মনে এক অন্ধ আক্রোশ সৃষ্টি হয় ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার প্রবল অনুপ্রেরণা জাগে।[২৮]

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি[সম্পাদনা]

বসনীয় বিপর্যয় সম্পর্কে ফরাসি ম্যাগাজিন "লে পেটিট জার্নাল"-এ প্রকাশিত একটি রঙ্গচিত্র। বুলগেরিয়া তার স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় এবং বুলগেরিয়ার রাজপুত্র ১ম ফার্ডিনান্ড নিজেকে জার দাবি করেন। সম্রাট ফ্রান্সিস জোসেফ, যিনি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে উপস্থাপন করছেন, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দখল করে নিচ্ছেন এবং উসমানীয় সুলতান ২য় আবদুল হামিদ অসহায় তাকিয়ে রয়েছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অংশগ্রহণকে ইতিহাসবিদগণ প্রায়ই স্বল্প গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, এবং প্রচলিত ভাবে জার্মানিকেই যুদ্ধের প্রধান উসকানীদাতা হিসেবে প্রদর্শন করা হয়।[২৯] যদিও, প্রথম যে স্ফুলিঙ্গটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বারুদে আগুন ধরিয়েছিল তা ছিল বসনীয়-সার্ব আততায়ী গাভরিলো প্রিন্সিপ কর্তৃক অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের হত্যাকাণ্ড, যা সংঘটিত হয় ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন। এর প্রায় এক মাস পরেই, ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলশ্রুতিতে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করে থাকে; এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরেই অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে শাসক হ্যাব্‌সবার্গ গোষ্ঠী যুদ্ধ সূচনা করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে।[২৯]

মহাযুদ্ধের সূত্রপাত সম্পর্কে আলোচনায় সাধারণতঃ কূটনৈতিক কারণসমূহই অগ্রগণ্য হিসেবে ধারণা করা হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের গভীরে নিহিত কিছু কারণ ছিল।[৩০] ১৯১৪ সালের বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পরিস্থিতি এর যুদ্ধে গমন করার একটি প্রাথমিক কারণ। বলকান অঞ্চলের স্লাভ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখন স্লাভ-ঐক্যের আন্দোলন চলছিল, যা ক্রমশঃ একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ নিচ্ছিল, এ ব্যপারটি অস্ট্রিয়ার হ্যাব্‌সবার্গ সাম্রাজ্যকে ভাবিয়ে তোলে। তৎকালীন ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য মোটেই একজাতীয় ছিল না, বরং এর ৫ কোটি জনসংখ্যা বিভক্ত ছিল ১১টি জাতীয়তার মধ্যে। এ সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি, ভাষা এবং জনগণ তাই ছিল এক বৈচিত্রপূর্ণ মিশ্রণ।[৩১]

বিশেষতঃ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে বসবাসরত দক্ষিণ-স্লাভীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা ছিল সার্বিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যাদের সাথে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি ছিল একসূত্রে বাঁধা। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যে প্রায় ৭০ লক্ষ দক্ষিণ-স্লাভীয় জনগণের বসবাস ছিল এবং এর বাইরে ছিল আরো ৩০ লক্ষ।[৩২] বিংশ শতাব্দীতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের যুগে, দক্ষিণ-স্লাভীয় জনগোষ্ঠীর ঐক্য ছিল অত্যন্ত আশাপ্রদ। এই সংকটময় পরিস্থিতির চিত্র বোঝা যায় ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের কাছে লেখা ফিল্ড মার্শাল কনরাড ফন হোজেনডর্ফের চিঠি থেকে:

দক্ষিণ স্লাভীয় জনগণের একতাবদ্ধ হওয়া সবচাইতে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনসমূহের অন্যতম, তাদেরকে অবজ্ঞা করা যাবে না কিংবা দমিয়ে রাখা যাবে না। এখন প্রশ্ন হল- এই ঐক্যবদ্ধকরণ সাম্রাজ্যের সীমান্তের ভেতরে হবে কিনা - যা হতে হবে সার্বিয়ার স্বাধীনতার বিনিময়ে - অথবা তারা ঐক্যবদ্ধ হবে সার্বিয়ার নেতৃত্বে, যা হবে সাম্রাজ্যের স্বার্থবিরোধী। সার্বরা স্বাধীন হলে সাম্রাজ্য এর দক্ষিণ স্লাভীয় ভূখণ্ড হারাবে, ফলে তার সমগ্র উপকূলই হস্তচ্যুত হবে। এই অঞ্চল হাতছাড়া হওয়া মানে সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড ও সম্মান উভয়েরই হানি- যার ফলে সাম্রাজ্য পরিণত হবে কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র শক্তিতে।[৩৩]

১৯০৮ সালে, বলকান অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্যারন ফন অ্যারেনথালের নির্দেশে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখল করা হয়। এটি ছিল স্লাভ জাতীয়তাবাদের ওপর চরম আঘাত এবং এ ঘটনায় সার্বিয়া বিক্ষুব্ধ হয়। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা আক্রমণ ছিল দক্ষিণ স্লাভ জাতির জন্যে এক "জাগরণের আহ্বান" স্বরূপ। এর ফলে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যকার সংঘাত বৃহদাকার ধারণ করে।[৩৪] উভয় রাষ্ট্রের পরিস্থিতি ছিল সংঘাতপূর্ণ এবং যেকোন মুহূর্তেই যুদ্ধ বেঁধে যাবার আশংকা ছিল, এমতাবস্থায় গাভরিলো প্রিন্সিপ নামক সার্ব জাতীয়তাবাদী আততায়ীর হাতে খুন হন অস্ট্রিয়া সম্রাটের উত্তরাধিকারী যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড, এই ঘটনায় পুরোদমে যুদ্ধ বেঁধে যায়।

স্লাভ জাতির এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মিত্রশক্তিসমূহের পূর্ণ সমর্থন ছিল। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জর্জ ম্যাকোলে ট্রেভেলিয়ানের মতে, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সার্বিয়ার যুদ্ধ ছিল "স্বাধীনতার যুদ্ধ", যা "দক্ষিণ স্লাভীয় জাতিকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিত"।[৩৫] তাঁর উদ্ধৃতিতে, "স্বাধীনতার জন্যে যদি কোন যুদ্ধ হয়ে থাকে, তা বর্তমানে সংঘটিত হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে, অস্ট্রিয়া ও ম্যাগিয়ারদের বিরুদ্ধে। যদি এ যুদ্ধে ম্যাগিয়ারদের শোষণের পতন হয়, তবে তা হবে জাতিগত স্বাধীনতা ও ইউরোপে শান্তি স্থাপনের দিকে এক বিশাল পদক্ষেপ।"[৩৬]

১৯১৪ সালের পূর্বে রাশিয়ার পরিস্থিতি[সম্পাদনা]

১৯১৪ সালের প্রাক্কালে, পূর্ববর্তী ছয় দশক ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে ও কূটনীতিতে রাশিয়ার ব্যর্থতায় রাষ্ট্রটির নৈতিক মনোবল ভেঙে পড়ে। রণকৌশল, কূটনীতি এবং অর্থনীতিতে ব্রিটেন এবং জার্মানি তখন বিশ্বে চালকের আসনে আসীন ছিল।[৩৭] এসব কারণে তাদের জাতীয় গর্ব, আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য ছিল তুঙ্গে। এসমস্ত কারণে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ তাদের রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকত এমনকি রাজ্যের অধীন অপরাপর জাতির জনগণও রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করত, যেমনটা দেখা যায় ব্যাভারিয়ান জাতির বার্লিনের প্রতি আনুগত্য কিংবা স্কট জাতির লন্ডনের প্রতি আনুগত্য।

১৯১৪ সালের পূর্ববর্তী সময়ে, অস্ট্রিয়া ও রুশদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক ছিল ইউরোপে শান্তি বজায় রাখার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ তবে এই সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত দুঃসাধ্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। বসনিয়া হামলার কারণে এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার পুরোনো শত্রুতা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং জাতিগত সংবেদনশীলতাও এতে প্রভাব ফেলে। এর একপ্রান্তে ছিল বলকান অঞ্চলের স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে রাশিয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব, অপরদিকে এই অঞ্চলের দখল বজায় রাখার জন্যে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিও ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।[৩৮] ১৯১৩-১৯১৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ তার নিজের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন ছিল যে ভিয়েনার মনমানসিকতা নিয়ে চিন্তাভাবনার মত ফুরসত তাদের ছিল না। প্রথম বলকান যুদ্ধে রাশিয়া কর্তৃক কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহকে যে ছাড় প্রদান করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহ তার বিনিময়ে কোন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মনোভাব প্রকাশ না করায় রাশিয়া ক্ষুব্ধ ছিল।[৩৯]

জার্মানির আগ্রাসী কর্মকাণ্ড রাশিয়ার ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ব্যজারভ এবং রুশ গোপনীয় গোয়েন্দা বিভাগ এই রিপোর্ট দেয় যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালনার ফলে জার্মান জনগণ ছিল রাশিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯১৪ সালের বসন্তে।[৪০]

রুশ সেনাবাহিনী ছিল তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম, যুদ্ধ শুরুর পূর্বে যার সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষ। প্রয়োজনে তারা ৫০ লক্ষ সৈন্যও মোতায়েন করতে পারত, যদিও তাদের মজুদে রাইফেল ছিল ৪৬ লক্ষ। তাছাড়া তাদের নেতৃত্বও ছিল দূর্বল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

প্রথম সংঘর্ষ (আগস্ট, ১৯১৪)[সম্পাদনা]

ট্যানেনবার্গের যুদ্ধক্ষেত্রে পল ফন হিন্ডেনবার্গ,
শিল্পী: হুগো ভোগেল।
হাঙ্গেরিতে রণাঙ্গনের একটি দৃশ্য।

১৯১৪ সালের ১৭ই আগস্ট রাশিয়া কর্তৃক পূর্ব প্রুশিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ, একই সাথে তারা আক্রমণ করে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির গ্যালিসিয়া প্রদেশ।[৪১] ১৯১৪ সালের আগস্টে ট্যানেনবার্গের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তাদের প্রথম আক্রমণটি পরাস্ত হয়।[৪২] তবে গ্যালিসিয়াতে রুশ বাহিনীর দ্বিতীয় একটি আক্রমণ সফল হয়, এবং ১৯১৪ সালের মধ্যেই তারা এ অঞ্চলটি সম্পূর্ণ দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে চারটি অস্ট্রিয়ান বাহিনী রুশদের হাতে পরাজিত হয়। জেনারেল নিকোলাই ইভানভ, জেনারেল নিকোলাই রুজস্কি এবং জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বরে রুশ সেনাবাহিনী গ্যালিসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং শেমিশ্‌ল দুর্গ নগরীতে অবরোধ স্থাপন করে। এই দুর্গটিই ছিল পোল্যান্ডের ক্রাকোভ নগরীর পূর্বে শেষ বাধা।[৪৩]

১৯১৪ সালের অস্ট্রো-রুশ সীমান্তে রুশ বাহিনীর সফল অভিযানে কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। জার্মান সাম্রাজ্য তার মিত্র অস্ট্রিয়ার সাহায্যার্থে একটি সুবিশাল সেনাবাহিনীকে পূর্বে প্রেরণ করে, যা "৯ম জার্মান সেনাবাহিনী" নামে পরিচিত। ১৯১৪ সালের শেষভাগে যুদ্ধক্ষেত্রের মূল কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে ভিস্টুলা নদীর পশ্চিমে কংগ্রেস-পোল্যান্ডে।[৪৪] অক্টোবরে সংঘটিত হয় "ভিস্টুলা নদীর যুদ্ধ" এবং নভেম্বরে "লোড্‌জ যুদ্ধ", যাতে জার্মান বাহিনী উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হয়, তবে অন্তত রুশ বাহিনীর আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।[৪৫]

১৯১৪-১৯১৫ সাল জুড়ে চলে কার্পেথিয়ান পর্বতমালার পাদদেশে রুশ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর সংঘর্ষ। শেমিশ্‌ল দুর্গ রুশ আক্রমণ প্রতিরোধ করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তবে রুশ বাহিনী এ দুর্গকে পেছনে ফেলে পশ্চিম অভিমুখে এগিয়ে যায় এবং পশ্চিমে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সেনাদের মুখোমুখি হয়। তারা অস্ট্রিয়দের হটিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হতে সক্ষম হয় এবং ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে কার্পেথিয়ান পর্বতমালা অতিক্রম করে। তবে এসময় জার্মান সেনাবাহিনী উপস্থিত হয় এবং তাদের সাহায্যে অস্ট্রীয় বাহিনী রুশদেরকে রুখে দিতে সক্ষম হয়। একই সময় রুশ বাহিনীর হাতে অবশেষে শেমিশ্‌ল দুর্গের পতন হয় এবং এ দুর্গে অবস্থিত অস্ট্রীয় বাহিনী পরাজিত ও শেমিশ্‌ল নগরী প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[৪৬]

১৯১৫[সম্পাদনা]

১৯১৫ সালে জার্মান সামরিক নেতৃত্ব পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং সে অনুযায়ী তাদের সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশকে পূর্বে স্থানান্তর করে। রুশ শক্তিকে দমিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহ ১৯১৫ সালে নতুন উদ্যমে আক্রমণ অভিযান আরম্ভ করে। তাদের পরিকল্পনার সূচনা হয় গ্যলিসিয়া আক্রমণের দ্বারা, যেখানে ১৯১৫ সালের "গোর্লিস-টার্নো অভিযানে" তারা সাফল্যের দেখা পায়।

রুশ সেনাদের যুদ্ধযাত্রা: রাজকীয় রক্ষীবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ সারির সেনাদের সাহায্যার্থে ছুটে যাচ্ছে।

"মাসুরিয়ান হ্রদের ২য় যুদ্ধের" পর পূর্ব রণাঙ্গনের জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনী একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়। তাদের উপর্যুক্ত আক্রমণটি একটি সাধারণ সম্মিলিত অগ্রযাত্রায় রূপ নেয় এবং অপরদিকে রুশ সেনারা কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করে। তবে রুশ বাহিনীর এ পিছু হটার কৌশলগত কারণের চেয়ে তাদের সরঞ্জামাদি সরবরাহের অভাবই ছিল প্রধান কারণ, বিশেষ তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। তাছাড়া রুশ অফিসারগণের দূর্নীতি ও দক্ষতার অভাব ছিল তাদের পলায়নের অপর একটি কারণ। শেষ পর্যন্ত, ১৯১৬ সাল নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধ-শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নতি সাধিত হওয়াতে তারা প্রয়োজনীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহে সক্ষম হয়।

পশ্চিম ইউক্রেনের চের্নিভস্টি নগরী, হ্যাব্‌সবার্গ শাসনামলে, ১৯১৫ সাল(আনুমানিক)।

১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রুশরা কংগ্রেস-পোল্যান্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয় অর্থ্যাৎ কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহের সীমান্তে থেকে কয়েক শত কিলোমিটার দূরে পিছিয়ে যায়। ফলে রুশ আক্রমণ থেকে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি অনেকাংশে নিরাপত্তা পায়। ১৯১৫ সালের শেষে জার্মান-অস্ট্রিয়ান সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রসরকে থেমে যায়, এসময় তাদের অবস্থান ছিল রিগা-জ্যাকবস্টেড-ডুনাবার্গ-বারানোভিচি-পিনস্ক-ডাবনো-টের্নোপিল লাইন বরাবর। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত লাইনটিই ছিল এ রণাঙ্গনের সম্মুখ সমরের প্রান্তর।

রুশ-তুর্কী সংঘর্ষ, ১৯১৫-১৬ সালের শীতকাল[সম্পাদনা]

সারিকামিশে তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়া জয়লাভ করলে রুশ-তুর্কী রণাঙ্গনে রাশিয়া একটি শক্তিশালী অবস্থানে এসে পড়ে। তুর্কী বাহিনী ব্যস্ত ছিল তাদের সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে এবং "আর্মেনীয় গণহত্যা" সংঘটনে।[৪৭] অপরদিকে, রাশিয়া ব্যস্ত থাকে পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের অপরাপর যুদ্ধক্ষেত্রসমূহে। তবে, ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, গ্র্যান্ড ডিউক নিকোলাস নিকোলিভিচকে ককেশাস অঞ্চলের রুশ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণের পর থেকে রুশ-তুর্কী রণাঙ্গনের মোড় ঘুরে যায়।

ডিসেম্বর মাসে গ্যালিপোলি থেকে মিত্রবাহিনী সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর, ককেশাস অঞ্চলের রুশ সেনাপ্রধান নিকোলাই ইউডেনিচ ধারণা করেন তুর্কী বাহিনী এবার তাঁর সৈন্যদের ওপর চড়াও হবে। তাঁর এই আশংকা যুক্তিযুক্ত ছিল: কেননা বুলগেরিয়া সেসময় জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, ফলে জার্মানি থেকে তুরস্ক পর্যন্ত স্থলপথ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং জার্মানির পক্ষে সম্ভব হয় তুরস্ককে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা।[৪৭] তবে রুশদের জন্যে "৩য় তুর্কী সেনাবাহিনীকে" ধ্বংস করার একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়, যখন ব্রিটিশগণ তুর্কীদের বিরুদ্ধে মেসোপটেমিয়াতে (ইরাক) যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সেখানে রুশদের সাহায্যপ্রার্থী হয়। ব্রিটিশ বাহিনীর বাগদাদ আক্রমণের পরিকল্পনা ইস্পাহানেই থমকে যায়, এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে তারা তুর্কী সেনাবাহিনীর উপর্যুপরী আক্রমণের শিকার হয়। এসময় ব্রিটিশরা রাশিয়াকে অনুরোধ করে তুর্কী আক্রমণের জন্যে এবং জেনারেল ইউডেনিচ সে অনুরোধে সাড়া দেন। সে অনুযায়ী ১৯১৬ সালের ১০ জানুয়ারি রুশ সেনাবাহিনী ককেশাস অঞ্চলে তুর্কীদের ওপর হামলা চালায় (এরজুরাম আক্রমণ)।[৪৮]

শীতকালের মাঝামাঝি রুশদের এই আক্রমণের জন্যে তুর্কীরা প্রস্তুত ছিল না। তাছাড়া সেসময় ৩য় তুর্কী বাহিনীর কমান্ডার কামিল পাশা এবং সেনাপ্রধান মেজর গুসে ছিলেন অবর্তমান। তদুপরি, তুর্কী বাহিনী সংখ্যায় ছিল রুশদের থেকে অনেক পিছিয়ে- ৩,২৫,০০০ রুশ সেনার বিরুদ্ধে তুর্কী সেনা ছিল মাত্র ৭৮,০০০- এই যুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়।[৪৮] তিন মাসব্যপী যুদ্ধের পর, ১৯১৬ সালের ১৮ই এপ্রিল, রুশ বাহিনী ট্রাবজোন নগরী দখল করতে সক্ষম হয়।

১৯১৬[সম্পাদনা]

রাশিয়ায় অলংকৃত প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রচারপত্র: বিশ্ব-অগ্নি, দ্বিতীয় দেশাত্ববোধক যুদ্ধ।

১৯১৬ সালের মিত্রবাহিনীর অভিযানসমূহের লক্ষ্য ছিল জার্মানিকে পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে পূর্ব রণাঙ্গনে স্থানান্তর করতে বাধ্য করা। যাতে "ভার্দুনের যুদ্ধে" ফরাসিদের ওপর থেকে কিছুটা ভার লাঘব করা যায়। এ পরিকল্পনা মোতাবেক রাশিয়া জার্মানির ওপর একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করে, যাতে জার্মানি রুশদের মোকাবিলা করার জন্যে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। রুশদের এই অভিযানের প্রথম আক্রমণ ছিল ১৯১৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে সংঘটিত "নারোখ হ্রদ-আক্রমণ", যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

ব্রুসিলভ আক্রমণ[সম্পাদনা]

ব্রুসিলভ আক্রমণ-অভিযান

১৯১৬ সালের ইতালীয় অভিযানে রাশিয়া অত্যন্ত লাভবান হয়: অস্ট্রিয়া এতে বাধ্য হয় দক্ষিণে রুশ রণাঙ্গন থেকে তাদের সৈন্য-ডিভিশনসমূহ প্রত্যাহার করে নিতে। এতে রাশিয়া সুযোগ পায় একটি পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করার, যার নাম দেয়া হয় "ব্রুসিলভ আক্রমণ-অভিযান"। ব্রুসিলভ অভিযানটি ছিল রুশ বাহিনী কর্তৃক গ্যালিসিয়ায় অবস্থানরত অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনীর ওপর পরিচালিত আক্রমণ। রুশ জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভের বিশ্বাস ছিল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে মনোনিবেশ করলে, কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করা তাঁর বাহিনীর পক্ষে সম্ভব। ব্রুসিলভ প্রস্তাব দেন রুশ সেনাবাহিনী যেন বিস্তৃত আকারে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং অস্ট্রিয়ার পরিখা থেকে মাত্র ৭৫ গজ দূরে তাদের পরিখা খনন করে।[৪৯]

ব্রুসিলভের পরিকল্পনা ব্যপকভাবে সফল হয়। রুশ বাহিনী অস্ট্রীয়দের তুলনায় সৈন্যসংখ্যায় এগিয়ে ছিল (রুশ ২,০০,০০০ সৈন্য, বনাম অস্ট্রিয়ার ১,৫০,০০০ সৈন্য) এবং তাদের অস্ত্রসম্ভারও ছিল উন্নত (রাশিয়ার ৯০৪টি কামান, অস্ট্রিয়ার ৬০০টি কামানের বিরুদ্ধে)। তাছাড়া এ যুদ্ধে রাশিয়া তার সেনাপতিগণের উদ্ভাবনী ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এবং সেনাপতিদের রণকৌশলও সাফল্যের দেখা পায়। রুশদের রণকৌশল ছিল স্বল্প দূরত্বে আচমকা আক্রমণ চালানো এবং নিয়মিত ও পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হয়ে ভূমি দখল করা (২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান জেনারেল এরউইন রমেলও অনুরূপ কৌশল অবলম্বন করে সফল হন)।[৫০] এ যুদ্ধে "৮ম রুশ সেনাবাহিনী", "৪র্থ অস্ট্রীয় বাহিনীকে" পরাস্ত করে এবং লুট্‌স্ক নগরী পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করে। রুশগণ তাদের প্রারম্ভিক অবস্থান থেকে ৪০ মাইল পথ অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। অস্ট্রিয়ার ১০ লক্ষাধিক সৈন্য হতাহত হয়, যার মধ্যে জুনের মাঝামাঝি ৫ লক্ষ সৈন্য নিহত কিংবা যুদ্ধবন্দী হয়।[৫০]

তবে, ব্রুসিলভ আক্রমণের প্রাথমিক সফলতার পর তা উল্লেখযোগ্যভাবে মন্থর হয়ে পড়ে। যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য ও প্রয়োজনমাফিক রসদ সরবরাহ না থাকায় জেনারেল ব্রুসিলভ জুন মাসে তাঁর প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও অগ্রসর হতে অপারগ হন। ব্রুসিলভ আক্রমণকে প্রথম যুদ্ধে রাশিয়ার বৃহত্তম সাফল্য হিসেবে গণ্য করা হয়।[১৯]:৫২ যদিও এ যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ রুশ সৈন্য হতাহত হয়, এ আক্রমণের ফলে কেন্দ্রীয় শক্তি তাদের সামরিক বাহিনীর একটি বড় অংশকে পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে পূর্বে মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। এবং এ আক্রমণ রোমানিয়াকে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করে, যার ফলে কেন্দ্রীয় শক্তির ততোধিক সৈন্য পূর্ব রণাঙ্গনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।[৫১]

রোমানিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

রোমানিয়া এ অভিযানের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যদি জার্মানরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যর্থ হয়, তবে এটি হবে তাদের জন্যে চরম বিপর্যয় বয়ে আনবে। পরবর্তীতে তাদের পরাজয় হবে কেবল সময়ের ব্যপার। কিন্তু জার্মানি যদি জয়লাভ করে, তবে এ অভিযানে আমাদের নিয়তি কী হবে সে বিষয়ে আমি সন্দিহান।... কিন্তু তবুও কেউ যুদ্ধের একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করা তাদের দায়িত্ব বলে মনে করেনি।

— ডেভিড লয়েড জর্জ, ওয়ার মেমোয়ার্স (War Memoirs)[৫২]
মিত্রবাহিনীর পক্ষে রোমানিয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রকাশিত একটি ব্রিটিশ প্রচারপত্র।

১৯১৬ সাল পর্যন্ত রোমানিয়া আগ্রহের সাথে মহাযুদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করছিল। যখন এবং যে পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে, সে অনুসারে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরিকল্পনা ছিল তাদের। রুশ ও ফরাসি কূটনৈতিকেরা রোমানিয়াকে বহু আগে থেকেই তাদের পক্ষ অবলম্বন করার জন্যে অনুরোধ করে আসছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের এ অনুরোধের প্রক্রিয়া তীব্রতর হতে থাকে। রোমানিয়ার রাজা ফার্ডিনান্ড তাঁর ৫ লক্ষ সৈন্যবিশিষ্ট সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে অবতীর্ণ করার আগে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি উপযুক্ত প্রস্তাব আশা করছিলেন।[৫৩] রোমানিয়ার হাঙ্গেরি-বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে, মিত্রবাহিনীকে তাদেরকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অধিকারে থাকা ট্রান্সিলভানিয়া প্রদেশটি হস্তান্তরের প্রস্তাব দেয়, ট্রান্সিলভানিয়ার জনগোষ্ঠী ছিল দৃঢ়ভাবে রোমানিয়া-পন্থী। শেষ পর্যন্ত ১৯১৬ সালের ১৮ই আগস্ট, মিত্রদের এ লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দেয় রোমানিয়া।[৫৪] এর ৯ দিন পর, ২৭এ আগস্ট, রোমানীয় সেনাবাহিনী ট্রান্সিলভানিয়ায় প্রবেশ করে।

রোমানিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াতে জার্মানি বাধ্য তাদের সমস্ত যুদ্ধ-পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বরে, জার্মান সেনারা পূর্ব রণাঙ্গন অভিমুখে যাত্রা করে। তদুপরি, জার্মান সেনাপ্রধান জেনারেল এরিখ ফন ফকেনহাইন বাধ্য হন তাঁর পদ ইস্তফা দিতে এবং তিনি পূর্ব রণাঙ্গনে রোমানিয়ার প্রতিরোধে নিযুক্ত কেন্দ্রীয়-শক্তির সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর সাহচর্যে থাকেন জেনারেল অগাস্ট ফন ম্যাকেনসেন। জার্মানিল কাইজার ২য় উইলহেম সঙ্গে সঙ্গেই ফকেনহাইমের প্রাক্তন পদে জেনারেল পল ফন হিন্ডেনবার্গকে নিযুক্ত করেন।[৫৫] ফন হিন্ডেনবার্গের সহকারী ছিলেন জেনারেল এরিখ লুডেনডর্ফ, যিনি ছিলেন ততোধিক দক্ষ ও রণকুশলী। লুডেনডর্ফকেই সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় এবং তিনি রোমানিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর বাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেন। ৩ সেপ্টেম্বর, কেন্দ্রীয় শক্তির সেনারা প্রথমবারের মত রোমানিয়া অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করে। একই সময়ে বুলগেরিয়ার বিমান বাহিনী রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে বোমা হামলা চালায়।[৫৬] এই আক্রমণ থেকে কিছুটা নিস্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে, ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী পশ্চিমে অপর একটি অভিযান পরিচালনা করে, যা পরিচিত "সোম-এর যুদ্ধ" নামে, একই সময়ে পূর্বে ব্রুসিলভ অভিযানও অব্যহত থাকে।

এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, রোমানিয়ার ন্যায় ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্রকে ইতোপূর্বে এত গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি, এবং, তা বিশ্বের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে এবং এমন একটি অনুকূল মুহূর্তে। এর পূর্বে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মত দুটি পরাশক্তিকে, তাদের বিশ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা-বিশিষ্ট একটি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সামনে নতজানু হতে হয়নি। সামরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায় যে, রোমানিয়া তাদের যেস্থানে ইচ্ছা সেস্থানেই অগ্রসর হতে পারত, তাতে বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সেই শক্তির অনুকূলে চলে যেত যারা বছরের পর বছর আমাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই সবকিছুই নির্ভর করছে রোমানিয়া তাদের এই ক্ষণিকের সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবে কিনা, তার উপর।

— পল ফন হিন্ডেনবার্গ, আউট অব মাই লাইফ (Out of My Life)[৫৭]

রোমানিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় ফন হিন্ডেনবার্গ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে পল ফন হিন্ডেনবার্গ নিম্নোক্ত এ আদেশ জারি করেন: "এখন সকল সেনাবাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হবে পশ্চিম, পূর্ব, ইতালীয় ও ম্যাসেডোনীয় রণাঙ্গনসমূহে তাদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা; অতঃপর বাড়তি সমস্ত বাহিনী রোমানিয়ার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা।"[৫৮] তবে কেন্দ্রীয় শক্তির সৌভাগ্যবশতঃ রোমানীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যা ও গুণমান সম্পর্কে তাদের যে উচ্চধারণা ছিল, বাস্তবে তা ভুল প্রমাণিত হয়। যদিও রোমানীয় সেনাবাহিনীতে ৫ লক্ষ সৈন্য ছিল, তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসরঞ্জাম ছিল নিম্নমানের।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অধিকৃত অঞ্চলে রোমানিয়ার প্রাথমিক সাফল্যের পর তারা অতি দ্রুতই কেন্দ্রীয় শক্তির দ্বারা পরাভূত হয়। উত্তর থেকে অগ্রসর হয় জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনী এবং দক্ষিণ থেকে রোমানিয়ায় প্রবেশ করে বুলগেরীয়-তুর্কী-জার্মান সম্মিলিত বাহিনী। রোমানিয়া উভয় প্রান্তেই একত্রে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা সমসাময়িক রণ-কুশলীগণের মতে ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত।[৫৯] নভেম্বরের মাঝামাঝি, জার্মান বাহিনী কার্পেথিয়ান পর্বতমালা অতিক্রম করে এবং এ অঞ্চলে রোমানিয়ার প্রতিরোধ বাহিনী ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫ ডিসেম্বর বুলগেরীয় সেনাবাহিনী দানিউব নদী পার হয়ে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট অভিমুখে অগ্রসর হয়। একই সময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সেনারা পূর্বে অগ্রসর হয় এবং তুর্কী বাহিনী পূর্ব থেকে সাগর পথে দুটি সৈন্য ডিভিশন দোব্রুজা অঞ্চলে পাঠায়।[৬০] পরিশেষে রোমানীয় বাহিনী সিরেট নদীর অপর পাড়ে উত্তর মলডাভিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশ্য তারা মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছিল, বিশেষ করে ফ্রান্স তাদের সাহায্যার্থে এক হাজারের অধিক অফিসার, চিকিৎসাকর্মী ও সহকারী কর্মী প্রেরণ করে।

১৯১৬ সালের সংঘাতের ফলাফল[সম্পাদনা]

১৯১৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে রোমানীয় বাহিনী তার অধিকাংশ লোকবল হারায়। প্রায় ১,৫০,০০০ রোমানীয় সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়, এবং প্রায় ২,০০,০০০ সৈন্য হতাহত হয়। এবং তারা তাদের রাজধানীসহ ভূখণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশের কর্তৃত্ব হারায়।[৬১] উল্লেখযোগ্যভাবে, তাদের প্লইয়েশ্‌ত তৈলক্ষেত্র হাতছাড়া হয়ে যায়, যা ছিল কৃষ্ণ সাগরের পশ্চিমে অবস্থিত ইউরোপের একমাত্র উল্লেখযোগ্য তেলের উৎস। কেন্দ্রীয় শক্তির হস্তগত হওয়ার আগেই তারা এই তৈলক্ষেত্রটি ধ্বংস করে দেয়।

১৯১৭[সম্পাদনা]

রাশিয়া - ফেব্রুয়ারি বিপ্লব[সম্পাদনা]

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, যা রুশ রাজপরিবারকে উত্খাত করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। এই বিপ্লব ছিল রাশিয়ার ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত, এবং বর্তমানেও বহু রাষ্ট্রে এর প্রভাব বিদ্যমান।[৬২] যদিও বহু রুশ নাগরিক চেয়েছিল একটি বিপ্লব সংঘটিত হোক, এ বিপ্লবটি বাস্তবে যেসময়ে এবং যে উপায়ে ঘটে, তা সকলের প্রত্যাশার বাইরে ছিল।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, বৃহস্পতিবার, ১৯১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি/ ৮ই মার্চ তারিখে, প্রায় ৯০,০০০ নারী কর্মী, পেট্রোগ্রাড শহরে তাঁদের কলকারখানার কর্মস্থল ছেড়ে নগরীর রাস্তায় বেরিয়ে আসেন, এবং স্লোগান দিতে থাকেন, "রুটি চাই!", "রাজতন্ত্র নিপাত যাক!" এবং "যুদ্ধ থামাও!" এই নারীরা ছিলেন ক্লান্ত, শ্রান্ত, অভুক্ত ও ক্ষুব্ধ।[৬৩] পরিবারের পুরুষেরা সব যুদ্ধক্ষেত্রে থাকায় পরিবারের উপার্জনের হাল তাঁদের ধরতে হয় এবং দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলকারখানার দুর্বিষহ পরিবেশে শ্রম দিয়ে পরিবারের খাদ্য-সংস্থান করতে হয়। তবে তাঁদের একাকী আন্দোলন করতে হয়নি, পরদিনই তাঁদের অনুসরণ করে আরও ১,৫০,০০০ নারী-পুরুষ আন্দোলনে যোগ দেয়।

২৫ ফেব্রুয়ারি, শনিবারের মধ্যে, পেট্রোগ্রাড নগরী কার্যতঃ স্থবির হয়ে যায়। কোন ব্যক্তিকে কর্মস্থলে যেতে দেয়া হয়না কিংবা নিজের ইচ্ছায় কাজে যোগ দেয় না।[৬৪] যদিও পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য কর্তৃক জনসমাবেশে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল, তবুও অধিকাংশ পুলিশ ও সৈন্য বিদ্রোহ করে বসে এবং জনতার পাশাপাশি আন্দোলনে যোগ দেয়।[৬৫] জার ২য় নিকোলাস সেসময় পেট্রোগ্রাড নগরীতে ছিলেন না, তবে আন্দোলনের খবর তাঁর কানে আসে এবং তিনি একে কোন প্রকার গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবে মার্চের ১ তারিখে স্বয়ং জার ব্যতীত সকলেরই বোধগম্য হয় যে, রাশিয়ায় জারের রাজত্বের সমাপ্তি হতে চলেছে। এবং ২রা মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর রাজত্বের অবসান ঘটে।[৬৬]

১৯১৭ সালে পূর্ব রণাঙ্গনের পরিস্থিতি।

রোমানিয়া - গ্রীষ্মকালীন অভিযান ও তার ফলাফল[সম্পাদনা]

১৯১৭ সালের জুলাই মাসে, রোমানীয় রণাঙ্গনে, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র একটি এলাকায়, সমগ্র যুদ্ধের বৃহত্তম সেনাসমাবেশ ও সংঘর্ষসমূহের একটি ঘটে যায়: এই ছোট অঞ্চলের সংঘর্ষে সমাবেত হয় ৯টি সেনাবাহিনী, ৮০টি পদাতিক ডিভিশনের অন্তর্গত ৯৭৪টি ব্যাটালিয়ন, ১৯টি অশ্বারোহী ডিভিশনের অন্তর্গত ৫৫০টি স্কোয়াড্রন এবং ৯২৩টি গোলন্দাজ দল- যার সর্বমোট সদস্য ছিল ৮,০০,০০০ সৈন্য, এবং তাদের নিকটবর্তী সংরক্ষিত বাহিনীতে আরো ১০ লক্ষ সৈন্য। এ যুদ্ধের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংঘর্ষ রোমানিয়ার ভবিষ্যৎ চিরদিনের জন্যে বদলে দেয় এবং সমগ্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গতিপথকেই পাল্টে দেয়। সংঘাত তিনটি ঘটে যথাক্রমে মারাস্তি, মারাশেস্তি ও ওইতুজ এলাকায়। এই তিনটি এলাকায় ১৯১৭ সালের শুরু থেকেই উভয় পক্ষের সম্মুখ সারি অবস্থান গ্রহণ করে আসছিল এবং ছয় মাস ব্যপী তাদের এই অবস্থানে ক্রমশঃ শক্তিবৃদ্ধি করে আসছিল।[৬৭]

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের শুরুর ভাগ পর্যন্ত, রোমানীয় সেনাবাহিনী একই সাথে মারাস্তি, মারাশেস্তি ও ওইতুজের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং জার্মান-অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রসরকে রুখে দেয়, তারা কেন্দ্রীয় শক্তির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে এবং মিত্রশক্তির পক্ষে ১৯১৭ সালে পূর্ব রণাঙ্গনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয়লাভ করে।

এই যুদ্ধের ফলাফলস্বরূপ রোমানিয়ার অবশিষ্ট অঞ্চলগুলো শত্রুমুক্ত থাকে, এ অঞ্চলে কেন্দ্র শক্তির প্রায় ১০,০০,০০০ সৈন্য ব্যস্ত থাকে। দ্য টাইম্‌স ম্যাগাজিন রোমানীয় রণাঙ্গনকে "পূর্বের একমাত্র আশার আলো" বলে আখ্যায়িত করে।

১৯১৮ সালের ৭ই মে, চলমান রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, রোমানিয়া বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে শান্তি চুক্তি স্থাপন করার, এই চুক্তিটি ছিল ১৯১৮ সালের "বুখারেস্ট চুক্তি", যা রোমানিয়ার ওপর কঠোর শর্তাবলী আরোপ করলেও তাদেরকে বেসারাবিয়া অঞ্চলটি ছেড়ে দেয়। জার্মান সমর্থিত আলক্সান্ডরু মার্গিলোমান প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। তবে, রাজা ফার্ডিনান্ড এ চুক্তি সাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।

জার্মানরা প্লইশ্‌তি তৈল ক্ষেত্রটি মেরামত করে পুনরায় কর্মক্ষম করতে সক্ষম হয় এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এর থেকে লক্ষ লক্ষ টন তেল উৎপাদিত হয়। এছাড়া রোমানীয় কৃষকদের কাছ থেকে অক্ষশক্তি ২০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য দাবি করে। এসমস্ত সম্পদ ও রসদ জার্মানিকে ১৯১৮ সালের শেষ অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে।[৬৮]

রাশিয়া - অক্টোবর বিপ্লব[সম্পাদনা]

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাত্র কয়েক মাসের মাথায়, ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, লেনিন বিশ্বাস করেন রুশ জনগণ আরেকটি বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত, এবার বিপ্লবের ভিত্তি হয় মার্ক্সবাদী মতাদর্শ।[৬৯] ১০ই অক্টোবর, বলশেভিক পার্টির নেতৃবিন্দ একটি গোপন বৈঠকের আয়োজন করে, লেনিন তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অন্য সকলকে বোঝান যে একটি সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনা করার জন্যে এটিই উপযুক্ত সময়। বলশেভিকদের প্রতি অনুগত সৈন্যেরা সকল টেলিগ্রাফ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ সেতু, ডাক-অফিস, রেল স্টেশন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক দখল করে নেয়।[৭০]

পেট্রোগ্রাড নগরী আনুষ্ঠানিকভাবে বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তারা পরিকল্পিতভাবে পেট্রোগ্রাডের কলকারখানা ও ব্যারাকসমূহে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। তারা পরিকল্পনা করতে থাকে সশস্ত্র বিপ্লব চালনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করার জন্যে।[৭১] ২৪শে অক্টোবর, শহরের উপকণ্ঠে তাঁর গোপন আস্তানা থেকে লেনিন আবির্ভূত হন, স্মোলনি সংগঠনে তাঁর সদর দপ্তর গড়ে তোলেন এবং তাঁর তিন ধাপ-বিশিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ছক আঁকতে থাকেন। সকল গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও রেললাইন তখন তাঁর বাহিনীর দখলে, বাকি ছিল শুধুমাত্র শীতকালীন প্রাসাদে অবস্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দপ্তর। ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যাবেলায় বলশেভিক পার্টির অনুগত সেনারা শীতকালীন প্রাসাদে প্রবেশ করে। প্রায় রক্তপাতহীন একটি বিপ্লব পরিচালনা করে বলশেভিক পার্টি হয়ে যায় রাশিয়ার নতুন কর্তা।[৭১] লেনিন ঘোষণা দেন নতুন সরকার যুদ্ধের অবসান ঘটাবে, ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল ভূমি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং কলকারখানাসমূহে শ্রমিকদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে।

১৯১৮[সম্পাদনা]

১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বলশেভিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করে। লেনিনের অধীনে নবগঠিত সরকার রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া শুরু করে। নভেম্বরে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯১৭ সালের ১৫ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। একই সময়ে বলশেভিকগণ তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণ উদ্যমে সামরিক অভিযান চালায়: বিশেষ করে ইউক্রেন এবং ডন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তারা আক্রমণ চালায়। নবগঠিত সোভিয়েত সরকার ও কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহের মধ্যকার শান্তি আলোচনায় জার্মানি বিশাল আকারে ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে, যা রাশিয়া মেনে নিতে নারাজ হয়, বহুদিনব্যপী তর্ক-বিতর্কের পর, ১৯১৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি সমঝোতা বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সমসাময়িকভাবে কেন্দ্রীয় শক্তিসমূহ ইউক্রেনের সাথেও একটি সমঝোতায় আসে, যারা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের ভূখণ্ড হারাচ্ছিল।[৭২] ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে সূত্রপাত হওয়া এই রুশ গৃহযুদ্ধ তিন বছর ব্যপী চলমান থাকে এবং রাশিয়াকে আভ্যন্তরীণভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। ১৯১৭ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহে রাশিয়ার অভ্যন্তরে লেনিন-বিরোধী বহু দল-উপদলের সৃষ্টি হয়। জার ২য় নিকোলাসের পতনের সুযোগে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের অনেক অঙ্গরাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে, যার অন্যতম ছিল ফিনল্যান্ড, যারা ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে, ফিনল্যান্ড নিজেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং আভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ের শিকার হয়। ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণার এক মাসের মাথায় লেনিন তাদের দাবি মেনে নেন। ফিনিশ জনসভা একজন জার্মান রাজপুত্রকে তাদের রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও ফিনল্যান্ডের লাল দল (সমাজতান্ত্রিক দল) এবং সাদা দল (রাজতন্ত্রপন্থী) ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে নিজেদের মাঝে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। লাল দল ফিনল্যান্ডকে একটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, এবং ফিনল্যান্ডে তখনো অবস্থানরত রুশ বাহিনী তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

ফিনল্যান্ডের সাদা দলের নেতৃত্ব দেন জেনারেল কার্ল গুস্তাফ ম্যানারহাইম, যিনি ছিলেন একজন ব্যারন এবং ১৫ বছর বয়স থেকে জারের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। এই সাদা দলটিকে জার্মানরা সমর্থন দেয় এবং জার্মান জেনারেল গোল্ট্‌জের নেতৃত্বে একটি জার্মান অভিযাত্রী সৈন্যবাহিনী তাদের সহায়তায় প্রেরিত হয়। যদিও জেনারেল ম্যানারহাইম জার্মানদের এই সাহায্যের প্রস্তাবে সম্মত হননি, তবুও জার্মান বাহিনী ১৯১৮ সালের এপ্রিলে ফিনল্যান্ডের উপকূলে অবতরণ করে।

লাল ফৌজ গঠন[সম্পাদনা]

১৯১৭ সালে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের রাজকীয় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী বিলুপ্ত হবার পর, লিওন ট্রট্‌স্কির নেতৃত্বে "গণ-কমিসার সংঘ" একটি নতুন বাহিনী গঠনে তত্পর হয়। ১৯১৮ সালের ২৮শে জানুয়ারি উক্ত সংঘ গোড়াপত্তন করে "শ্রমিক ও জনগণের লাল ফৌজ"-এর; এই বাহিনী স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে। তবে, ২২শে এপ্রিলে সোভিয়েত সরকার কায়িক শ্রমে নিযুক্ত নয় এমন সকল নাগরিকদের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা দেয়। যদিও লাল ফৌজের অধিকাংশ সদস্য ছিল কৃষক ও শ্রমিক, এর অফিসারগণের অবস্থান ছিল প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর অফিসারদের মতই।[৭৩]

ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি (মার্চ, ১৯১৮)[সম্পাদনা]

১৯১৮ সালের ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার হস্তচ্যুত ভূখণ্ড।

১৯১৮ সালের ৩ মার্চ, জার্মান সেনাবাহিনী রুশ রাজধানী পেট্রোগ্রাড (সেন্ট পিটার্সবার্গ) থেকে মাত্র ৮৫ মাইল দূরে অবস্থান নেয়, এমতাবস্থায় সাক্ষরিত হয় "ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক চুক্তি" এবং পূর্ব-রণাঙ্গনে সকল যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। যদিও চুক্তিটি সাক্ষরের এক বছরের মাথায় তা নাকোচ হয়ে যায়, এটি বলশেভিকদের কিছু সময়ের জন্যে নিষ্কৃতি প্রদান করে, যারা গৃহযুদ্ধে চড়িয়ে পড়েছিল এবং ইউক্রেনের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া সিদ্ধান্ত নেয় একটি "সংযুক্ত বাল্টিক ডাচি" গঠন করার, যা একজন জার্মান যুবরাজ তথা ডিউক কর্তৃক শাসিত হবে এবং এ রাষ্ট্রের প্রধান থাকবেন স্বয়ং জার্মান কাইজার। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিনল্যান্ডের অভ্যুদয় হয়, এবং ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, যদিও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এ স্বীকৃতি দেয়নি। এসমস্ত ঘটনার পর জার্মানি পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক সৈন্য স্থানান্তর করার সুযোগ পায় এবং ১৯১৮ সালের বসন্তে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানির এই আক্রমণ মিত্রদের রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হয়, এবং ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জার্মানি পিছিয়ে পড়তে থাকে। রাশিয়ার পতনের পরেও প্রায় ১০ লক্ষ জার্মান সেনা পূর্বে রয়ে যায়, এবং ইউরোপে জার্মান সাম্রাজ্যের একটি ক্ষণস্থায়ী উপবৃদ্ধি স্থাপন করে। তবে, শেষ পর্যন্ত জার্মানি ও অস্ট্রিয়া তাদের অধিকৃত সকল অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারায়, এবং ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর সাক্ষরিত চুক্তিসমূহে (যেমন ভার্সাই চুক্তি) অপরাপর ভূখণ্ডও তাদের হস্তচ্যুত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পূর্ব রণাঙ্গনে নারীদের ভূমিকা[সম্পাদনা]

সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট একাটেরিনা টিওডোরিউ, ১৯১৭ সালের মারাসেস্তির যুদ্ধে নিহত হন, তিনি রোমানিয়ার জাতীয় বীর হিসেবে গণ্য হন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পশ্চিম রণাঙ্গনে নারীগণের ভূমিকা যেভাবে আলোচিত হয়ে থাকে, সে তুলনায় পূর্ব রণাঙ্গনের নারীর ভূমিকা ঐতিহাসিক আলোচনায় ঐরূপ গুরুত্ব পায় নি। ধারণা করা হয়, রাশিয়ার শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের শতকরা ২০ ভাগই সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত হয়; ফলে নারীরা বাধ্য হন শিল্পক্ষেত্রে শ্রমে নিযুক্ত হতে। নারীদের নিয়োগের ফলে সকল শিল্পেই লোকবল বৃদ্ধি হয়, বিশেষ করে শিল্পক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের পরিমাণ ১৯১৩ সালের ৩১.৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯১৮ সালে ৪৫ শতাংশে দাঁড়ায়।[৭৪]

পূর্ব রণাঙ্গনে নারীরা যুদ্ধক্ষেত্রেও অবতীর্ণ হন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়সমূহে রাশিয়া এর নারী সৈন্যদের নিয়ে নতুন ইউনিট- নারী ব্যাটালিয়নসমূহ গঠন করে, যা সেনাবাহিনীতে নতুন লোকবলের যোগান দেয়, এবং সৈন্যদের ভেঙে পড়া মনোবলকে পুনরায় উজ্জীবিত করে। রোমানীয় সেনাবাহিনীতে একাটেরিনা টিওডোরিউ প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে নিহত হন এবং রোমানিয়ায় তিনি জাতীয় বীর হিসেবে তাঁকে স্মরণ করা হয়।

ব্রিটিশ নার্সগণের ভূমিকা শুধুমাত্র পশ্চিম রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের ধূসর ওভারকোটের কারণে তাঁরা "গ্রে প্যাট্রিজেস" বা "ধূসর তিতির" নামে পরিচিত ছিলেন। এলসি ইংলিসের নেতৃত্বে স্কটিশ স্বেচ্ছাসেবী নার্সগণ ১৯১৬ সালে রোমানিয়ায় আগমন করেন। আহত সেনাদের সেবাদানের পাশাপাশি স্কটিশ নার্সগণ পরিবহন যান চালনা ও রেজিমেন্টের রাঁধুনীর দায়িত্বও পালন করে থাকেন।[৭৫] "গ্রে প্যাট্রিজেস"-এর সদস্যগণ রোমানীয়, সার্ব ও রুশ সেনাদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত হন এবং রোমানীয় প্রচার মাধ্যম তাঁদেরকে উল্লেখ করে, "স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী ও রোদে পোড়া নারীগণ" বলে। এলসি ইংলিস ও তাঁর অনুসারী স্বেচ্ছাসেবী নার্সগণের অবদানের একটি নিদর্শন হল, তাঁদেরকে অনুমতি দেয়া হয় রোমানিয়ার গ্যালাটি নগরের একটি পরিত্যক্ত দালানকে মেরামত করে একটি কার্যকর হাসপাতাল স্থাপন করার, যা তাঁরা মাত্র একদিনের মধ্যেই সফলভাবে স্থাপন করেন।[৭৬] ইভোন ফিট্‌জরয় কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল, "রোমানিয়ায় স্কটিশ নার্সগণ", পূর্ব রণাঙ্গনে স্কটিশ নার্সগণের ভূমিকা সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।[৭৭]

রাশিয়ায় যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা[সম্পাদনা]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ লক্ষ জার্মান সৈন্য এবং ২৫ লক্ষ অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সৈন্য রুশদের হাতে বন্দী হয়। ১৯১৪ সালের অভিযানে রাশিয়া শত শত অস্ট্রীয়কে আটক করে। এই বিপুল সংখ্যক বন্দীদের রাখার জন্যে তাই রুশ কর্তৃপক্ষ জরুরী ভিত্তিতে বহুসংখ্যক জেলখানা নির্মাণ করে। অস্ট্রীয় বন্দীদের রাখার জন্যে কিয়েভ, পেনজা, কাজান এবং পরবর্তীতে তুর্কেস্তানে এরূপ জেলখানা নির্মিত হয়। যুদ্ধ চলাকালে এরূপ জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। রুশ সমর-অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে, রুশ জার সরকার এই যুদ্ধবন্দীদেরকে শ্রমশক্তি হিসেবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। বহু যুদ্ধবন্দীকে কৃষিকাজে ও খনি-শ্রমিক হিসেবে ডোনবাস ও ক্রিভোই-রগ শহরে কাজে নিযুক্ত করা হয়। তবে অধিকাংশ বন্দীদের নিযুক্ত করা হয় খাল খনন ও রেল লাইন নির্মাণের কাজে। এসকল কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। খাদ্য, সুপেয় পানি এবং ঔষধপত্রের যথেষ্ট অভাব ছিল। গ্রীষ্মকালে এসব স্থানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা যেত, তাছাড়া অপুষ্টিজনিত কারণে বন্দীদের মাঝে স্কার্ভি রোগ ছড়িয়ে পড়ে। মুরমানস্ক রেল নির্মাণ কর্মসূচিতে এসকল কারণে ২৫,০০০-এরও অধিক বন্দী প্রাণ হারায়। বন্দীদের প্রতি এসমস্ত অবিচারের খবর জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে পৌঁছালে তাদের সরকার যুদ্ধবন্দী নিপীড়ণের অভিযোগ তোলে। রাশিয়ার জার সরকার প্রথমত এসমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে। তাদের এই অস্বীকারের কারণ ছিল একই সময়ে রুশ যুদ্ধবন্দীদেরকেও সার্বিয়াতে রেল নির্মাণে কাজে লাগানো হচ্ছিল। তবে, ধীরে ধীরে বন্দীদের দ্বারা কয়েদ খাটানো বন্ধ হয়ে আসে।[৭৮] এসব বন্দীশিবিরে জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। জার সরকার বন্দীদেরকে যথেষ্ট খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করার ক্ষমতা ছিল না, মূলতঃ সম্পদের অভাব ও কূটনৈতিক শত্রুতাই ছিল এসব রসদ সরবরাহে অবহেলার কারণ। অবশ্য, কোন কোন শিবিরের অবস্থা অন্যগুলোর তুলনায় ভাল ছিল।[৭৮]

পূর্ব রণাঙ্গনে রোগ-ব্যাধির বিস্তার[সম্পাদনা]

পূর্ব রণাঙ্গনে প্রাননাশের একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল রোগব্যাধি। পূর্বে যুদ্ধ-সংঘাতে যত না প্রাণহানি হয়, তার থেকে চার গুণ বেশি মৃত্যু হয় রোগ-ব্যাধিতে। তুলনামূলকভাবে, পশ্চিম রণাঙ্গনে রোগ-ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যুদ্ধে প্রাণহানির তিনগুণ।[৭৯] ম্যালেরিয়া, কলেরা ও ডিসেন্ট্রি মহামারী আকারে পূর্ব রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে; তবে, সর্বাধিকসংখ্যক মৃত্যুর কারণ ছিল উকুনজাতীয় কীটবাহিত একপ্রকার টাইফয়েড-যুক্ত জ্বর, যে রোগ ইতোপূর্বে জার্মান ডাক্তারদেরও অজানা ছিল। এই রোগের বিস্তারে ভূমিকা রাখে পূর্ব রণাঙ্গনের প্রাকৃতিক পরিবেশ। শহরগুলোতে উপচে পড়া শরণার্থীর ভিড়ে, এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এ রোগের জীবাণু বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। জার্মান অধিকৃত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (ওবার-ওস্ট) পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতির শোচনীয় অবস্থা ছিল এবং চিকিৎসা সেবার যথেষ্ট অভাব ছিল।[৮০]

অবশেষে, একটি বড় আকারের পরিচ্ছন্নতা অভিযান আরম্ভ করা হয়। এই অভিযানের নাম ছিল স্যানিটাট্‌সওয়েসেন বা "স্বাস্থ্য কর্মসূচি", এর আওতায় লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতির ব্যপক উন্নয়ন সাধিত হয়। বহু কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র নির্মিত হয়, এবং রোগাক্রান্ত এলাকাসমূহকে অপরাপর এলাকা থেকে আলাদা করা হয়। টাইফয়েড-যুক্ত জ্বর প্রতিকারে গ্রামে-গঞ্জে ও শহরগুলোতে উকুননাশক কেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং সকল নাগরিকগণকে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক গোসলখানায় উকুননাশক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করানো হয়। "স্বাস্থ্য পুলিশবাহিনী" গঠন করা হয়, যাদের দায়িত্ব ছিল ঘরে ঘরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা হয়েছে কিনা, তা নজরদারি করা। কোন বসতবাড়ি যথেষ্ট পরিষ্কার না হলে, তাতে তক্তা-পেরেক মেরে সীল করে দেয়া হয় এবং সাবধানতা-সংকেত ঝুলিয়ে দেয়া হয়।[৮০] রোগ ছড়াবার আশংকায় রোগাক্রান্ত কুকুর-বেড়ালও নিধন করা হয়।

রোগ-জীবাণু বিস্তার প্রতিরোধে অপর যে ব্যবস্থা গৃহীত হয়, তা হল পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ। যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাদেরকে অনুমতিপত্র প্রদান করা হয়, ধারণা করা হয় প্রায় ৭০ শতাংশ যৌনকর্মী বিভিন্ন যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল।[৮০] সামরিক পতিতালয়সমূহে কড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়; কৌনো নগরীতে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়, যার মধ্যে ছিল কনডম ব্যবহার, যৌনমিলনের পর যৌনাঙ্গ ধৌতকরণ এবং কোন রোগব্যাধি দেখা গেলে চিকিত্সকের পরামর্শ গ্রহণ প্রভৃতি।[৮০]

হতাহতের সংখ্যা[সম্পাদনা]

পরিসংখ্যান ব্যবস্থার অনুন্নতির কারণে রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা নির্ণয় করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য।

কর্নিশের মতে নিহত রুশ সৈন্যের সংখ্যা ২০,০৬,০০০ জন, (যার মধ্যে, ৭,০০,০০০ যুদ্ধে নিহত, ৯,৭০,০০০ ক্ষত থেকে নিহত, ১,৫৫,০০০ রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত, এবং ১,৮১,০০০ যুদ্ধবন্দী অবস্থায় মৃত)। রাশিয়ার হতাহতের এই সংখ্যা অনেকটা ব্রিটিশ হতাহতের সংখ্যার সাথে মিলে যায়, যাদের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মোট পুরুষ জনসংখ্যার ৫ শতাংশ যুদ্ধে নিহত হয়। তাঁর মতে, প্রথম দুই বছরে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা আনুমানিক ৫ থেকে ৬ লক্ষ, যা গণনা করা সম্ভব হয়নি। সর্বমোট বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ লক্ষাধিক হওয়া "অসম্ভব নয়"। বন্দী করা হয় প্রায় ৫০ লক্ষ পুরুষ নাগরিককে, যার অধিকাংশই বন্দী হয় ১৯১৫ সালে।[৮১]

রাশিয়া যখন যুদ্ধে ইস্তফা দেয়, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার হাতে তাদের প্রায় ২৫,০০,০০০ যুদ্ধবন্দী আটক ছিল। যা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মিলিত যুদ্ধবন্দীর সংখ্যাকেও (১৮,৮০,০০০) ছাড়িয়ে যায়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বাহিনীর প্রায় ২২,০০,০০০ সৈন্য বন্দী হয়, যুদ্ধবন্দীর সংখ্যায় তারাই একমাত্র রুশদের কাছাকাছি ছিল।[৮২]

যুদ্ধে অবতীর্ণ রাষ্ট্রসমূহের অধিকৃত এলাকার পরিবর্তন[সম্পাদনা]

অস্ট্রিয়া[সম্পাদনা]

এ যুদ্ধের ফলে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্য তার অধিকৃত অঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশই হারায়, এবং একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, একমাত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যার জনসংখ্যা ছিল ৬৫ লক্ষ (যুদ্ধপূর্ব জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি ২৮ লক্ষ)। এই ক্ষতির ফলে ভিয়েনা হয়ে পড়ে একটি সাম্রাজ্যবিহীন রাজধানী। অস্ট্রিয়ার আশপাশে নতুন স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলো তখনো আশংকায় ছিল পূর্বের ন্যায় প্রবল শক্তিধর অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য আবারো পুনর্জাগরিত হতে পারে, তাই অস্ট্রিয়ার ওপর তারা কড়া নজরদারী রাখে এবং তারা যেন আবার ক্ষমতায় না আসতে না পারে সেজন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।[৮৩]

চেকোস্লোভাকিয়া[সম্পাদনা]

চেক-অধ্যুষিত বোহেমিয়া ও মোরাভিয়া প্রদেশের সাথে (পূর্বে অস্ট্রিয়ার শাসনাধীন) স্লোভাকিয়া ও রুথেনিয়াকে (পূর্বে হাঙ্গেরির শাসনাধীন) সংযুক্ত করে গঠিত হয় নতুন চেকোস্লোভাকিয়া প্রজাতন্ত্র। যদিও চেক, স্লোভাক ও অপরাপর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তর তারতম্য ছিল, তাদের বিশ্বাস ছিল তাদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহ একত্রিত হলে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। এই নবগঠিত বহুজাতিক রাষ্ট্রটির জনগণে মধ্যে অন্তর্গত ছিল চেক জাতি (৫১%), স্লোভাক (১৬%), জার্মান (২২%), হাঙ্গেরীয় (৫%) এবং রুসিন (৪%) এছাড়াও অপরাপর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী (২%)।[৮৪]

এর মধ্যে অনেক জার্মান, হাঙ্গেরীয়, রুথেনীয় ও পোল জনগণ[৮৫] এবং স্লোভাকদের একাংশ ভাবতে শুরু করে তারা শোষণের শিকার হচ্ছে, কেননা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদের সায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দিত না। রাষ্ট্র ঘোষণা করে দেয় যে, "চেক" ও "স্লোভাক" বলতে কোন জাতি থাকবে না, বরং তারা সকলে মিলেই "চেকোস্লোভাক" জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেবে, তবে স্লোভাকসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরা এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। যদিও ক্ষণস্থায়ীভাবে তখন এই বিরোধের সমঝোতা হয়, তবুও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর চেক ও স্লোভাকদের মধ্যে পুনরায় বিরোধ বেধে যায়।

হাঙ্গেরি[সম্পাদনা]

যুদ্ধের ফলে হাঙ্গেরি ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় এবং তার ভূখণ্ডের ৭২ শতাংশ, জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ এবং বিস্তর প্রাকৃতিক সম্পদ হারায়। তাদের হারানো ভূখণ্ডের পরিমাণ ছিল অস্ট্রিয়ার অনুরূপ, যাদের সাথে সম্মিলিতভাবে তারা প্রাক্তন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য গঠন করেছিল। তাদের হারানো ভূখণ্ডসমূহের মধ্যে অন্তর্গত ট্রান্সিলভানিয়া, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লাভোনিয়া, সিরমিয়া ও বানাট প্রদেশসমূহ।[৮৩]

ইতালি[সম্পাদনা]

ইতালি অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে ট্রিস্ট ও টাইরোল প্রদেশের কর্তৃত্ব পায়।

পোল্যান্ড[সম্পাদনা]

মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ১৪ দফা দাবির একটি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম পোল্যান্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ১৮শ শতাব্দীর পর প্রুশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া কর্তৃক পোল্যান্ড রাষ্ট্রটি দখলকৃত ও বিভক্ত হয়। ১৯১৯ সালের প্যারিস সম্মেলনে "পোলিশ বিষয়ক কমিশন" গঠিত হয় এবং তারা দাবি করে প্রুশিয়া ও পোসেনের মধ্যে একটি যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের জন্যে, যাতে পোল্যান্ড ভিস্টুলা নদীর মোহনায় অবস্থিত বাল্টিক সাগরের বন্দর "ডানজিগ"-এ প্রবেশাধিকার পায়। পোল্যান্ড রাষ্ট্র স্থাপনে, পূর্ব প্রুশিয়ার ১৫ লক্ষ জার্মান নাগরিক জার্মানির মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এছাড়াও ঊর্ধ্ব সাইলেসিয়া প্রদেশটি পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড কার্জন প্রস্তাব দেন পোল্যান্ডের পূর্ব সীমান্ত যেন রাশিয়ার সীমান্তবর্তী হয়। তাঁর এ সিদ্ধান্তে পোলিশগণ এবং সোভিয়েত রাশিয়া উভয় পক্ষই অসন্তুষ্ট হয়।[৮৩]

রোমানিয়া[সম্পাদনা]

যুদ্ধের পর রোমানিয়ার আয়তন ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্যারিস সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোমানিয়া দোব্রুজা ও ট্রান্সিলভানিয়ার কর্তৃত্ব বজায় রাখে। যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার মধ্যে একটি মৈত্রী সংগঠন স্থাপিত হয়, যার নাম দেয়া হয় "ক্ষুদ্র এন্টেন্ট" (পূর্ববর্তী এন্টেন্ট ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মৈত্রী সংগঠন)। তাদের বৈদেশিক নীতি ছিল একসূত্রে বাঁধা, যার মূল লক্ষ্য ছিল হ্যাব্‌সবার্গ রাজতন্ত্রের পুনর্জাগরণ প্রতিরোধ করা। (অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রাজবংশ ছিল হ্যাবসবার্গ রাজপরিবার)।[৮৩]

যুগোস্লাভিয়া[সম্পাদনা]

যুগোস্লাভিয়া প্রথমে পরিচিত ছিল "সার্ব, ক্রোয়াট ও স্লোভেন সাম্রাজ্য" নামে। ১৯২৯ সালে এ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় যুগোস্লাভিয়া। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে রাষ্ট্রটি এর ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই বহুজাতীয় রাষ্ট্রের জনগণ ছিল জাতীয়, ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত, ফলে অচিরেই দেখা দেয় বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ বিবাদ ও কলহ। এসকল কারণে পরবর্তীতে যুগোস্লাভিয়া জাতি, ভাষা, অর্থনীতি ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে।[৮৩]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. McRandle & Quirk 2006, পৃ. 697।
  2. "Sanitatsbericht fiber das Deutsche Heer... im Weltkriege 1914–1918", Bd. Ill, Berlin, 1934, S. 151. 149,418 casualties in 1914, 663,739 in 1915, 383,505 in 1916, 238,581 in 1917, 33,568 in 1918. Note: the document notes that records for some armies are incomplete.
  3. Churchill, W. S. (1923–1931). The World Crisis (Odhams 1938 ed.). London: Thornton Butterworth. Page 558. Total German casualties for "Russia and all other fronts" (aside from the West) are given as 1,693,000 including 517,000 dead.
  4. Bodart, Gaston: "Erforschung der Menschenverluste Österreich-Ungarns im Weltkriege 1914–1918", Austrian State Archive, War Archive Vienna, Manuscripts, History of the First World War, in general, A 91. Reports that 60% of Austro-Hungarian killed/wounded were incurred on the Eastern Front (including 312,531 out of 521,146 fatalities). While the casualty records are incomplete (Bodart on the same page estimates the missing war losses and gets a total figure of 1,213,368 deaths rather than 521,146), the proportions are accurate. 60% of casualties equates to 726,000 dead and 2,172,000 wounded.
  5. Volgyes, Ivan. (1973). "Hungarian Prisoners of War in Russia 1916–1919". Cahiers Du Monde Russe Et Soviétique, 14(1/2). Page 54. Gives the figure of 1,479,289 prisoners captured in the East, from the Austro-Hungarian Ministry of Defence archives.
  6. Erickson, Edward J. Ordered to die : a history of the Ottoman army in the first World War, p. 147. Total casualties of 20,000 are given for the VI Army Corps in Romania.
  7. Atlı, Altay (25 September 2008). "Campaigns, Galicia". turkesywar.com. Archived from the original on 20 July 2011. Total casualties of 25,000 are given for the XV Army Corps in Galicia.
  8. Yanikdag, Yucel (২০১৩)। Healing the Nation: Prisoners of War, Medicine and Nationalism in Turkey, 1914–1939। Edinburgh: Edinburgh University Press। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 978-0-7486-6578-5 
  9. Министерство на войната (1939), p. 677 (in Bulgarian)
  10. Симеонов, Радослав, Величка Михайлова и Донка Василева. Добричката епопея. Историко-библиографски справочник, Добрич 2006, с. 181 (in Bulgarian
  11. Кривошеев Г.Ф. Россия и СССР в войнах XX века. М., 2001 – Потери русской армии, табл. 52 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৬-১১-১৮ তারিখে, Krivosheeva, G.F. (2001). Rossiia i SSSR v voinakh XX veka : poteri vooruzhennykh sil : statisticheskoe issledovanie / pod obshchei redaktsiei. Moscow: OLMA-Press See Tables 52 & 56]. This total of 9,347,269 refers to Russian casualties on all fronts including the Balkans Campaign and the Caucasus Campaign; though the overwhelming majority of these would be suffered on the Eastern Front.
  12. Scheidl, Franz J.: Die Kriegsgefangenschaft von den ältesten Zeiten bis zur Gegenwart, Berlin 1943, p. 97.
  13. Cox, Michael; Ellis, John (2001). The World War I Databook: The Essential Facts and Figures for all the Combatants. London: Aurum Press.
  14. Erlikman, Vadim (2004). Poteri narodonaseleniia v XX veke : spravochnik. Moscow. Page 18 আইএসবিএন ৯৭৮-৫-৯৩১৬৫-১০৭-১.(Civilians killed on Eastern Front)
  15. Erlikman, Vadim (2004). Poteri narodonaseleniia v XX veke : spravochnik. Moscow. Page 51 আইএসবিএন ৯৭৮-৫-৯৩১৬৫-১০৭-১.
  16. Erlikman, Vadim (2004). Poteri narodonaseleniia v XX veke : spravochnik. Moscow. Page 49 আইএসবিএন ৯৭৮-৫-৯৩১৬৫-১০৭-১.
  17. The Great Retreat, Eastern Front 1915 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ মার্চ ২০১৫ তারিখে Military History Online. Michael Kihntopf.
  18. Brusilov Offensive Begins, June 4 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ মার্চ ২০১৫ তারিখে history.com.
  19. Tunstall, Graydon A. (২০০৮)। "Austria-Hungary and the Brusilov Offensive of 1916"The Historian70 (1): 30–53। ডিওআই:10.1111/j.1540-6563.2008.00202.x 
  20. Golovin, Nicholas (১৯৩৫)। "Brusilov's Offensive: The Galician Battle of 1916"। The Slavonic and East European Review13 (39): 571–96। 
  21. Roshwald, Aviel; Stites, Richard, সম্পাদকগণ (১৯৯৯)। European Culture in the Great War:The Arts, Entertainment and Propaganda 1914–1918। Cambridge: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 6,349–358। আইএসবিএন 978-0-521-01324-6 
  22. Miller, William (১৯২২)। The Balkans: Roumania, Bulgaria, Serbia and Montenegro। London: T. Fisher Unwin Ltd। পৃষ্ঠা 474। 
  23. Hitchins, Keith (১৯৯৪)। Rumania:1866–1947। Oxford: Clarendon Press। পৃষ্ঠা 153–4। 
  24. Keegan, John (১৯৯৮)। the First World War। New York: Random House Inc.। পৃষ্ঠা 306। 
  25. Lieven 1983, পৃ. 5।
  26. Lieven 1983, পৃ. 8।
  27. Lieven 1983, পৃ. 27।
  28. Oxana Nagornaja, Jeffrey Mankoff; Jeffrey Mankoff (২০০৯)। "United by Barbed Wire: Russian POWs in Germany, National Stereotypes, and International Relations"Explorations in Russian and Eurasian History10 (3): 475–498। ডিওআই:10.1353/kri.0.0111। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪ 
  29. Williamson, Samuel R. (১৯৯১)। Austria-Hungary and the Origins of the First World War। New York: St. Martin's Press। পৃষ্ঠা 1 
  30. Mason, John W. (১৯৮৫)। The Dissolution of the Austro-Hungarian Empire 1867–1918। London: Longman Group Limited। পৃষ্ঠা 61। 
  31. Mamatey, Albert (১৯১৫)। "The Situation in Austria-Hungary"। The Journal of Race Development6 (2): 204। 
  32. Mason, John W. (১৯৮৫)। The Dissolution of the Austro-Hungarian Empire 1867–1918। London: Longman Group Limited। পৃষ্ঠা 67। 
  33. Mason, John W. (১৯৮৫)। The Dissolution of the Austro-Hungarian Empire 1867–1918। London: Longman Group Limited। পৃষ্ঠা 67। 
  34. Williamson, Samuel R. (১৯৯১)। Austria-Hungary and the Origins of the First World War। New York: St. Martin's Press। পৃষ্ঠা 72 
  35. Trevelyan, George Macaulay (জুন ১৯১৫)। "Austria-Hungary and Serbia"The North American Review201 (715): 860। 
  36. Trevelyan, George Macaulay (জুন ১৯১৫)। "Austria-Hungary and Serbia"The North American Review201 (715): 868। 
  37. Lieven 1983, পৃ. 35।
  38. Lieven 1983, পৃ. 39।
  39. Lieven 1983, পৃ. 42।
  40. Lieven 1983, পৃ. 49।
  41. Gilbert, Martin (১৯৯৪)। The First World War: A Complete History। New York: Henry Holt and Companyআইএসবিএন 0-8050-1540-X 
  42. "Battle of Tannenberg (World War I)"Encyclopædia Britannica। ২০১৩-১০-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৩-০৫ 
  43. Marshall, Samuel Lyman Atwood (২০০১)। World War I। New York: American Heritage। পৃষ্ঠা 113–114। আইএসবিএন 0-618-05686-6। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৩-০৫ 
  44. Dupuy ও Onacewicz 1967, পৃ. 31।
  45. Dupuy ও Onacewicz 1967, পৃ. 3।
  46. Dupuy ও Onacewicz 1967, পৃ. 15–16।
  47. Jukes, Geoffrey (২০০২)। Essential Histories: The First World War, The Eastern Front 1914–1918। Oxford: Osprey Publishing। পৃষ্ঠা 38। 
  48. Jukes, Geoffrey (২০০২)। Essential Histories: The First World War, The Eastern Front 1914–1918। Oxford: Osprey Publishing। পৃষ্ঠা 39। 
  49. Keegan, John (১৯৯৮)। The First World War। New York: Random House Inc.। পৃষ্ঠা 303–4। 
  50. Keegan, John (১৯৯৮)। The First World War। New York: Random House Inc.। পৃষ্ঠা 304। 
  51. Vinogradov, V. N. (১৯৯২)। "Romania in the First World War: The Years of Neutrality, 1914–16"। The International History Review14 (3): 452–461 [p. 453]। ডিওআই:10.1080/07075332.1992.9640620 
  52. Lloyd George, David (১৯৩৮)। War Memoirs। London: Odhams। পৃষ্ঠা 1:549। 
  53. Mosier, John (২০০২)। The Myth of the Great War। New York: Perennial। পৃষ্ঠা 254। 
  54. Mosier, John (২০০২)। The Myth of the Great War। New York: Perennial। পৃষ্ঠা 256। 
  55. Gilbert, Martin (১৯৯৪)। The First World War: A Complete History। New York: Henry Holt and Company। পৃষ্ঠা 282। 
  56. Gilbert, Martin (১৯৯৪)। The First World War: A Complete History। New York: Henry Holt and Company। পৃষ্ঠা 283। 
  57. Paul von Hindenburg, Out of My Life, Vol. I, trans. F.A. Holt (New York: Harper & Brothers, 1927), 243.
  58. Gilbert, Martin (১৯৯৪)। The First World War: A Complete History। New York: Henry Holt and Company। পৃষ্ঠা 287। 
  59. Mosier, John (২০০২)। The Myth of the Great War। New York: Perennial। পৃষ্ঠা 259। 
  60. Keegan, John (১৯৯৮)। The First World War। New York: Random House Inc.। পৃষ্ঠা 306। 
  61. Mosier, John (২০০২)। The Myth of the Great War। New York: Perennial। পৃষ্ঠা 260। 
  62. McCauley 1975, পৃ. 79।
  63. McCauley 1975, পৃ. 84।
  64. McCauley 1975, পৃ. 87।
  65. McCauley 1975, পৃ. 86।
  66. McCauley 1975, পৃ. 88।
  67. România în anii primului război mondial, vol. 2, p. 834
  68. John Keegan, World War I, pg. 308
  69. McCauley 1975, পৃ. 89।
  70. McCauley 1975, পৃ. 92।
  71. McCauley 1975, পৃ. 94।
  72. Kowalski 1997, পৃ. 115।
  73. "Red Army - Soviet history"britannica.com। ২০১৬-০৬-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১০-২২ 
  74. Goldman, W. Z. (২০০২)। Women at the Gates: Gender and Industry in Stalin's Russia। Cambridge: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 10–11। 
  75. Coroban, Costel (২০১২)। Potarnichile gri. Spitalele Femeilor Scotiene in Romania (1916–1917)। Târgovişte: Cetatea de Scaun। পৃষ্ঠা 18। 
  76. Coroban, Costel (২০১২)। Potarnichile gri. Spitalele Femeilor Scotiene in Romania (1916–1917)। Târgovişte: Cetatea de Scaun। পৃষ্ঠা 65–6। 
  77. Fitzroy, Y. (১৯১৮)। With the Scottish Nurses in Roumania। London: John Murray। 
  78. Gatrell, Peter (২০০৫)। "Prisoners of War on the Eastern Front during World War I"Kritika6 (3): 557–566। ডিওআই:10.1353/kri.2005.0036। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৮, ২০১৪ 
  79. Liulevicius 2000, পৃ. 22।
  80. Liulevicius 2000, পৃ. 81।
  81. Cornish, Nik (২০০৬)। The Russian Army and the First World War। Stroud: Tempus। আইএসবিএন 1-86227-288-3 
  82. "WWI Casualties and Deaths"PBS। ২০১৬-১০-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৩-০৭ 
  83. Tucker, Spencer .C (১৯৯৮)। The Great War 1914–18। Bloomington: Indiana University Press। পৃষ্ঠা 220–223। 
  84. "The War of the World", Niall Ferguson Allen Lane 2006.
  85. "Playing the blame game"। জুন ৩০, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৬-৩০ , Prague Post, 6 July 2005
  1. Of the 3,343,900 Russian troops captured, 1,269,000 were captured by the Austro-Hungarians, with around 2 million captured by the Germans.[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]