অনুশীলন সমিতির ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ ভ্রূণাকারে দানা বাধতে থাকে ১৯ শতকের প্রথম দিকে। কংগ্রেস পরিচালিত ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে আলাদা ভাবে বৈপ্লবিক পথে সংগ্রামের চেতনা থেকে অন্য একটি ধারার জন্ম হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তরুন যুব সমাজের ওপর দেহচর্চা, লাঠিখেলা, তরোয়ালবাজি ইত্যাদি চিন্তা বিশেষ ছাপ ফেলেছিল। ফরাসি বিপ্লব, রাশিয়ান নিহিলিজম বা নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবের বিষয়ে পঠনপাঠন ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও জংগী আন্দোলনের প্রেরণা বহন করে আনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের তুলনায় বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে থাকে তরুনরা, যাতে ইন্ধন যোগায় কলকাতা, চট্টগ্রাম ও দেশব্যাপী ঘটে চলা আন্দোলনগুলি। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আগেই সীমিত হতে থাকে এই সমিতির কার্যকলাপ এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল গঠনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড।

প্রাক কথন[সম্পাদনা]

পতনোন্মুখ মুঘল সাম্রাজ্য এবং শিখ, মারাঠা ও নিজামের ক্ষমতা হ্রাস , বাংলা, অযোধ্যা ও অন্যান্য আঞ্চলিক ক্ষমতাশালী রাজন্যবর্গের পতনের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ওপর বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। ভারতে আঞ্চলিক বিভিন্নতা থাকলেও শিক্ষিত সমাজের ভেতর সামগ্রিক জাতীয়তা বোধের উন্মেষ ঘটে এই সময়।[১] ১৮ শতকের শেষ ভাগে যা নিয়ে আসে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জোয়ার।

১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহে বাংলা তূলনামূলক ভাবে কম উদ্বেলিত হয়েছিল - মাত্র চট্টগ্রাম, ঢাকা, ব্যারাকপুর ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ রাজ তাদের শাসন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করে ও শিক্ষিত নব্য 'বাঙালী বাবু' সংস্কৃতির জন্ম হয়। এই মধ্যবিত্ত 'ভদ্রোলোক' শ্রেনীর হাতে চলে আসে চাকরি, প্রশাসনিক কেরানীর পদ, এবং বাঙালীর প্রধান পরিচয় হয় আরামপ্রিয় যুদ্ধবিমুখ হিসেবে।

অনুশীলন সমিতি[সম্পাদনা]

প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

১৯০২ সাল নাগাদ অরবিন্দ ঘোষ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথের কলকাতা আসার ব্যবস্থা করার পরে যুব সঙ্ঘ ও ব্যামাগার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির প্রতি মনোনিবেশ করেন। যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বিভূতিভূষন ভট্টাচার্য, সরলা দেবী ঘোষাল, প্রমথনাথ মিত্রের যোগাযোগ হয়। তখন কলকাতায় কিছু ক্লাব ও ব্যামাগার ছিল যার মধ্যে অধিক পরিচিত ছিল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ব্যামাগার যেটি সরলাদেবী নিজে চালাতেন। এছাড়া ছিল সতীশ চন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতি, আত্মোন্নতি সমিতি ইত্যাদি। সতীশ বসু নিজে জেনারেল এসেম্বলি ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও স্বামী বিবেকানন্দের শাক্ত দর্শন প্রভাবিত ব্যক্তি ছিলেন। বিবেকানন্দের দুই শিষ্য ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামী সারদানন্দর সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। নিবেদিতা জাপানী ব্যক্তিত্ব কাকুজ ওকাকুরার সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন, শ্রী বসুর ওপর জাতীয়তাবাদী চিন্তা, চেতনার প্রভাব পড়ার ক্ষেত্রে এনাদের অবদান ছিল। লাঠি খেলা, দেহ চর্চা ইত্যাতিদে নিয়োজিত সতীশ বসু স্বদেশী শিল্পের অন্যতম সমর্থক ছিলেন।। স্বামী সারদানন্দ ও নিবেদিতার প্রভাবে তার হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠা হল অনুশীলন সমিতির। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন তত্ব অনুসারে গঠিত এই সমিতি শারীরীক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সক্ষমতা উন্নতির জন্যে কাজ করতে থাকে তরুনসমাজের ভেতর। যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সাথে অনুশীলন সমিতির সংযোগ ঘটে প্রমথনাথ মিত্রের হাত ধরে। সমিতির সদস্য সংগ্রহ শুরু হয় তরুনদের ভেতর থেকে, ছাত্রদের গীতা শপথ রাখতে হত। মা দুর্গার শাক্তমূর্তির আরাধনা ছিল মূল মন্ত্র। এই কারণেই সেযুগের মুসলিম সমাজের কাছে গ্রহণযগ্যতা পায়নি সমিতির কর্মকাণ্ড। তলোয়ার খেলা, ড্রিল্‌, মুষ্টিযুদ্ধ ও কুস্তির চর্চা করানো হতো সদস্যদের। সাপ্তাহিক পঠন পাঠনে জাতীয় আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক উন্নতির কথা বলা হত। প্রথম দিকে সমিতির কার্যকলাপ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। ১৯০৩ সালে অরবিন্দ তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে কলকাতা পাঠান। যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে মতপার্থক্যের ফলে বারীন্দ্রকে আবার বরোদায় চলে যেতে হয়। কলহ ও মতবিরোধের জন্যে অনুশীলন সমিতির কাজ বৃহৎ আন্দোলনের আকার দিতে পারেনা।

ঢাকা অনুশীলন[সম্পাদনা]

১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে বিপিনচন্দ্র পাল প্রমথনাথ মিত্রের সাথে ঢাকা যান একটি রাজনৈতিক আলোচনায় যোগ দিতে। সেই সভায় শ্রী পাল স্বেচ্ছাসেবকদের আহবান করেন মাতৃভূমির জন্যে ত্যাগ ও কর্মে নিজেদের উৎসর্গ করতে। বিপ্লবী পুলিন বিহারি দাসকে নেতা করে পূর্ববঙ্গে অনুশীলন সমিতির কাজকর্ম শুরু হয়। ৫০০ এরও অধিক শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।[২] অন্যান্য ক্ষুদ্র বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলিকে সাথে নিয়ে ঢাকা অনুশীলন সমিতি বৃহৎ আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং কলকাতার মূল সমিতির চাইতেও বড়ো হয়ে ওঠে যা ১৫০০০ থেকে ২০০০০ সদস্য সংখ্যায় পৌঁছে যায়। পরবর্তী দু বছরের ভেতর ঢাকা অনুশীলন সমিতি স্বদেশী আন্দোলনের অভিমুখ বিপ্লবী রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Mitra, Subrata K (2006), The Puzzle of India's Governance: Culture, Context and Comparative Theory, New York: Routledge, আইএসবিএন ০৪১৫৩৪৮৬১৭. 
  2. "অনুশীলন সমিতি - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-০৩