তামবোরা পর্বত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
তামবোরা পর্বত
১৮১৫ সালের মহাঅগ্নূৎপাতে গঠিত তামবোরা পর্বতের আকাশ হতে গৃহীত আলোকচিত্র
সর্বোচ্চ বিন্দু
উচ্চতা২,৭২২ মিটার (৮,৯৩০ ফুট)
সুপ্রত্যক্ষতা২,৭২২ মিটার (৮,৯৩০ ফুট)
তালিকাভুক্তিUltra
Ribu
ভূগোল
তামবোরা পর্বত ইন্দোনেশিয়া-এ অবস্থিত
তামবোরা পর্বত
তামবোরা পর্বত
Location in Indonesia
অবস্থানSumbawa, Lesser Sunda Islands, Indonesia
ভূতত্ত্ব
শিলার বয়স57,000 years
পর্বতের ধরনStratovolcano/Caldera
সর্বশেষ অগ্ন্যুত্পাত1967 ± 20 years

তামবোরা পর্বত একটি সক্রিয় স্তরীভূত কোণ আকারের আগ্নেয়গিরি যা ইন্দোনেশিয়ার সুমবাওয়া দ্বীপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সুমবাওয়ার উত্তর ও দক্ষিণে ভুগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের উচ্চভাগ অবস্থিত, এবং এর নিচের টেকটোনিক প্লেটের অন্তক্রিয়ার ফলেই তামবোরা পর্বতের উৎপত্তি। তামবোরা পর্বতের উচ্চতা প্রায় ৪,৩০০ মিটার (১৪,১০০ ফিট)[১] যা একে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম সুউচ্চ শৃঙ্গে পরিনত করে। এর ভেতরের ম্যাগমা চেম্বার কয়েক দশক ধরে পুর্ণ হতে থাকে, এবং ১০ এপ্রিল ১৮১৫ তে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়।[২] এর ফলে অগ্নুৎপাত ঘটে। অগ্নুৎপাতের আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদণ্ড (volcanic explosivity index) ছিলো ৭। এটির ছিলো ১৮০ খ্রীষ্টাব্দের লেক ট্যুপো অগ্নুৎপাতের পর একমাত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদণ্ডে ৭ মাত্রার অগ্নুৎপাত।[৩] (তবে ধারণা করা হয় ৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দের পায়েকটু পর্বতের অগ্নুৎপাত অগ্নেয় বিস্ফোরক মানদণ্ডে ৭ মাত্রার হতে পারে)। তামবোরা পর্বতের সর্বশেষ অগ্নুৎপাত ঘটে ১৯৬৭ সালে, যা আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদণ্ডে ০ মাত্রার ছিলো।

তামবোরা আগ্নেয়গিরির ১৮১৫ সালের অগ্নুৎপাত ইতিহাসের সব থেকে বৃহৎ অগ্নুৎপাত যার নিঃসরণ আয়তন ছিলো ১৬০ বর্গ কিলোমিটার। বিস্ফোরনের শব্দ ২০০০ কিলোমিটার (১২০০ মাইল) দূরবর্তী সুমাত্রা দ্বীপেও শুনা গিয়েছিলো। ভারী আগ্নেয় ছাই বোর্নিও, সুলাওয়েসি, জাভা ও মালুকু দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। অগ্নুৎপাতের নিঃসরণের ফলে নির্গত বর্জ্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভূমির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়, ফলে খাদ্যাভাব ও বিভিন্ন রোগে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তামবোরা আগ্নেয়গিরির ১৮১৫ সালের অগ্ন্যুৎপাতে অন্তত ৭১০০০ মানুষের প্রাণহানী ঘটে, যার মধ্যে ১১০০০–১২০০০ সরাসরি অগ্ন্যুৎপাতে মারা যায়,[৩] বাকিরা পরবর্তীতে খাদ্যাভাব ও বিভিন্ন রোগে প্রাণ হারান। মৃতের সংখ্যা ৯২০০০ বলে বহুল প্রচলিত হলেও তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।[৪][৫]

এই অগ্নুৎপাত পৃথিবীজুড়ে আবহাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে রয়েছে "আগ্নেয় শীতকাল"। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের আবহাওয়ায় প্রভাবের ফলে ১৮১৬ সাল পরিচিত হয় "গ্রীষ্মকাল বিহীন বছর" নামে। উত্তর গোলার্ধের বিভিন্ন স্থানে শস্য ধ্বংস হয় ও গবাদি পশু মারা যায়। ফলশ্রুতিতে ১৯শ শতকের সবথেকে ক্ষতিকর দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত হয়।

২০০৪ সালে সংঘটিত এক খননকার্যের সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৮১৫ এর অগ্ন্যুৎপাতে চাপা পড়া বিভিন্ন সংস্কৃতিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন।[৬] এগুলো ৩ মিটার গভীর পাইরোক্লাস্টিকের নিচে চাপা পড়েছিল। এই নিদর্শনগুলো ঠিক ১৮১৫ সালের অবস্থানেই রয়েছে। এই স্থানকে "পূবের পাম্পেই" বলা হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান[সম্পাদনা]

তামবোরা পর্বত সুমবাওয়া দ্বীপে অবস্থিত। এটি নিম্ন সুন্দা দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। নিম্ন সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ সুন্দা বাকের অংশ, যেটি আগ্নেয় দ্বীপসমুহের একটি ক্রমধারা যা ইন্দোনেশিয়ান আর্কিপেলাগোর দক্ষিণাংশ গঠন করে।[৭] তামবোরা সুমবাওয়ার সাংগার পেনিনসুলা গঠন করে। এই পেনিনসুলার উত্তরে ফ্লোরেস সাগর এবং দক্ষিণে সালেহ উপসাগর যা ৮৬ কিলোমিটার (৫৩ মাইল) লম্বা এবং ৩৬ কিলোমিটার (২২ মাইল) প্রশস্ত। সালেহ উপসাগরের উপকন্ঠে ৩০০০০ হেক্টর আয়তনের একটি দ্বীপ আছে যার নাম "মোয়ো" (ইন্দোনেশিয়ান ভাষায়ঃ পুলাও মোয়ো)। উক্ত দ্বীপে একটি অতিথি নিবাস ও সরাইখানা আছে যেখানে প্রিন্সেস ডায়ানা অবস্থান করেছিলেন।[৮]

তামবোরা পর্বতের প্রতি ভুতাত্ত্বিক ও আগ্নেয়গিরী গবেষক এর যেমন আগ্রহ রয়েছে, ঠিক একইভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক ও জীববিজ্ঞানীরাও সমান আগ্রহী। এছাড়াও হাইকিং ও প্রানীবৈচিত্র অবলোকনের জন্য এটি সুপরিচিত টুরিস্ট স্পট।[৯][১০] এর নিকটবর্তী দুটি শহর হলো ডম্পু এবং বিমা। তামবোরা পর্বতের ঢালে তিনটি গ্রামাঞ্চল রয়েছে। পুর্বে রয়েছে সাঙ্গার গ্রাম, উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে ডোরো পেটি ও পেসাংগ্রাহান এবনবগ পশ্চিমে রয়েছে ক্যালাবাই নামক গ্রাম।

তামবোরা ও সুমবাওয়ার টপোগ্রাফিক মানচিত্র

ক্যালডেরা পৌছাতে তিনটি পথ ব্যবহার করা হয়। প্রথম পথ তামবোরা পর্বতের দক্ষিণে দোরো বোহা গ্রাম হতে শুরু হয়ে একটি বাধানো রাস্তা দিয়ে কাজুবাদামের বাগানের মধ্য দিয়ে যায়। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১১৫০ মিটার (৩৭৭০ ফিট) উচ্চতা অবধি পৌছায়। এই পথের শেষেই ক্যালডেরার দক্ষিণাংশ অবস্থিত যা ১৯৫০ মিটার (৬৪০০ ফিট) উচ্চতায় অবস্থিত। এটি একট হাইকিং পথের মাধ্যমে পৌছানো যায়।[১১] এই স্থানটি মাত্র ১ ঘণ্টা দুরত্বে হওয়ার আগ্নেয়গিরির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে এই স্থানটি বেস ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় পথটি তামবোরা পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি সোরো পেটি গ্রাম হতে শুরু হয়। এখানেই তামবোরা আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র অবস্থিত। তৃতীয় পথটি পানকাসিলা গ্রাম হতে শুরু হয় এবং একটি কফি বাগান এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। তৃতীয় পথটি দ্বারা ক্যালডেরাতে শুধুমাত্র হেটে পৌছানো সম্ভব।[১১] তামবোরার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ক্যালডেরার পশ্চিম বলয়ে অবস্থিত।

আগস্ট, ২০১১ তে তামবোরা পর্বতের আসেপাশে ভুমিকম্প ও ধোয়া দেখা গেলে আগ্নেয়গিরিটির সতর্কতা সংকেত লেভেল ১ হতে লেভেল ২ এ উন্নিত করা হয়।[১২]

ভু-তাত্ত্বিক ইতিহাস[সম্পাদনা]

সৃষ্টি[সম্পাদনা]

মহাকাশ হতে তামবোরা ও সংলগ্ন অঞ্চলসমূহ

তামবোরা জাভা ট্রেঞ্চ সিস্টেমের ৩৪০ কিলোমিটার (২১০ মাইল) উত্তরে এবং সক্রিয় উত্তরবর্তী সাবডাকশন জোনের উপরীতলের ১৮০-১৯০ কিলোমিটার (১১০-১২০ মাইল) উপরে অবস্থিত। সুমবাওয়া উত্তর ও দক্ষিণ উভয় প্রান্তেই সামুদ্রিক খোলসে আবৃত।[১৩] এর অগ্রসরের হার প্রতি বছরে ৭.৮ সেমি (৩.১ ইঞ্চি)।[১৪] তামবোরা আনুমানিক ৫৭০০০ বছর আগে গঠিত হয়েছিলো।[২] এর অভ্যন্তরের একটি বড় ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ শুষ্ক হয়ে যায়। উক্ত ভুতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২৫০০০ বছর পুর্বে সালেহ উপসাগরে মোজো দ্বীপপুঞ্জের আবির্ভাব হয়।[২]

১৮১৫ সালের পুর্বের ভু-তাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, তামবোরার আকার যেকোন স্ট্রাটো-আগ্নেয়গিরির মতই। এক্ষেত্রে তামবোরা একটি প্রতিসম কোনাকার আগ্নেয়গিরি যার উচ্চতা ৪৩০০ মিটার (১৪১০০ ফিট)। এতে একটিমাত্র অগ্নিনির্গমন ছিদ্র রয়েছে।[১৫] কেন্দ্রীয় অগ্নিনির্গমন পথ প্রায়ঃশই গলিত লাভা উদঃগীরন করতো, যা একটি ঢালু পথে গড়িয়ে পড়তো।

১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাতের পর, তামবোরা পর্বতের সর্বনিম্ন অংশটি একাধিক স্তরীভূত লাভা ও পাইরোক্লাসটিক বস্তুতে গঠিত হয়। ১ হতে ৪ মিটার পুরূ লাভার প্রবাহ এই স্তরের ৪০% গঠন করে।[১৫] লাভা প্রবাহের ভগ্নাংশের ফলেই পুরূ স্কোরিয়া তট তৈরি হয়। অপেক্ষাকৃত উপরের দিকে লাভা মিশ্রিত হয় স্কোরিয়া, টাফ ও পাইরোক্লাসটিক উপাদান এর সাথে। অন্ততপক্ষে ২০ টি শাখা বা অনুজীবি কোনের উপস্থিতি লক্ষনীয়,[১৪] যার মধ্যে রয়েছে টেহে, ৮৪৪ মিটার (২৭৬৯ ফিট); মোলো, ৬০২ মিটার (১৯৭৫ ফিট); কাডিয়েন্ডিনেই; কুবাহ, ১৬৪৮ মিটার (৫৪০৭ ফিট) এবং ডোরো আপি টই। বেশিরভাগ অনুজীবি কোন ব্যাসাল্টিক লাভা উদঃগীরণ করে।

অগ্নূৎপাতের ইতিহাস[সম্পাদনা]

আগ্নেয়গিরীর চুড়ায় ক্যালডেরা

রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে ১৮১৫ সালের পুর্বে সংঘটিত আরো ৩ তিনটি অগ্নূৎপাতের হদিস পাওয়া গেছে।[১৬] তবে এই অগ্নূৎপাতগুলোর আকার সম্বন্ধে সঠিক তথ্য নেই। অগ্নূৎপাতগুলোর আনুমানিক সময়কাল খ্রীষ্টপুর্ব ৩৯১০ ± ২০০ অব্দ, খ্রীষ্টপুর্ব ৩০৫০ অব্দ এবং ৭৪০ ± ১৫০ খ্রীষ্টাব্দ। এগুলো প্রত্যেকটিই একইপ্রকার কেন্দ্রীয় চুল্লি অগ্নূৎপাত ছিলো। তবে ৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে সংঘটিত অগ্নূৎপাতে কোনপ্রকার পাইরোক্লাসটিক প্রবাহ ছিলোনা।

১৮১২ সালে তামবোরা পর্বতে একটি উচ্চমাত্রায় সক্রিয় সময়কালের সুচনা হয়। এপ্রিল, ১৮১৫ এর অগ্নূৎপাতের মধ্য দিয়ে উক্ত সময়কালের সমাপ্তি ঘটে।[১৬]

তামবোরা পর্বত এখনো সক্রিয়। ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে কিছুসংখ্যক ছোট আকারের লাভা গম্বুজ ও প্রবাহ গঠিত হয়েছে। সর্বশেষ অগ্নূৎপাতের ঘটা ঘটে ১৯৬৭ সালে। এই অগ্নূৎপাতটি খুবই দুর্বল ছিলো, আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদন্ডে যা ০ মাত্রার।

২০১১ সালেও একইপ্রকার ক্ষুদ্র আকারের অগ্নূৎপাতের ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়।[১৭]

১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাত[সম্পাদনা]

১৮১৫ সালের আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদন্ডে ৭ মাত্রার অগ্নূৎপাতটির টেফরা ইজেক্টা আয়তন ছিলো ১৬০ বর্গ কিলোমিটার (৩৮ কিউবিক মাইল)।[১৬] উক্ত অগ্নূৎপাতটি বিস্ফোরক কেন্দ্রীয় প্রকোষ্ঠ অগ্নূৎপাত ছিলো এবং এর সাথে পাইরোক্লাসটিক প্রবাহও ঘটে ও ক্যালডেরা ধ্বসে যায়। ফলশ্রুতিতে সুনামি ঘটে এবং জান ও মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এই অগ্নূৎপাত বৈশ্বিক আবহাওয়ায় দীর্ঘ মাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। ১৫ জুলাই ১৮১৫ তে আগ্নেয়গিরীর সক্রিয়তা প্রশমিত হয়। পরবর্তীতে ১৮১৯ এর আগস্টে পুনরায় সক্রিয়া দেখা যায় ও আগ্নেয় বিস্ফোরক মানদন্ডে ২ মাত্রার অগ্নূৎপাত ও ভুমিকম্প অনুভূত হয়। এই ঘটনাটিকে ১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাতেরই অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৩] ১৮৮০ ± ৩০ বছর পুর্বে তামবোরায় পুনরায় অগ্নূৎপাত শুরু হয়, তবে এটি ক্যালডেরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।[১৬] ক্ষুদ্রাকৃতির লাভা প্রবাহ ও লাভা গম্বুজ সৃষ্টি হয়। উক্ত অগ্নূৎপাতের ফলে ক্যালডেরার অভ্যন্তরে ডোরো আপি টই অনুজীবি কোন সৃষ্টি হয়।[১৮] ১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাত তামবোরা পর্বত অগ্নূৎপাত, ১৮০ খ্রীষ্টাব্দের তাউপো হৃদের অগ্নূৎপাত এবং বায়েকডুর তিয়ানশি অগ্নূৎপাত বিগত ৫০০০ বছরের ভেতর সবথেকে বড় অগ্নূৎপাতগুলোর অন্তর্গত। বিগত ২০০০ বছরে ১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাতটি সবথেকে বিদ্ধংশী বলে বিবেচিত হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য[সম্পাদনা]

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসারে তামবোরা পর্বতের ১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাত সংলগ্ন সুমবাওয়ার সংস্কৃতিকে চিরতরে মুছে দেয়।[১৯]

বাস্তুতন্ত্র[সম্পাদনা]

১৮৪৭ সালে সুইস উদ্ভিদবিজ্ঞানী হাইনরিখ জোলিঙ্গারের নেতৃত্বে একটি বিজ্ঞানীর দল সুমবাওয়া এসে পৌছায়।[২০] তারা স্থানীয়দের সাহায্যে ক্যালডেরার পুর্বের তটে পৌছায়।[২১] জোলিঙ্গারের উদ্দেশ্য ছিলো অগ্নূৎপাতের স্থানটি পর্যবেক্ষণ করা ও স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা। অগ্নূৎপাতের পরে জোলিঙ্গারই প্রথম ব্যক্তি যিনি চূড়ায় পৌছান। চূড়াটি তখনো ধোয়াচ্ছন্ন ছিলো। জোলিঙ্গার যখন উপরে উঠছিলেন তখন একধিকবার তার পা গরম ও পাউডারের মত সালফারের স্তরে দেবে যায়। গাছপালা দ্রুতই নিজেদের স্থান করে নেয় এবং তিনি ঢালের গায়ে কিছু গাছের সন্ধান পান। ২২০০-২৫৫০ মিটার (৭২২০-৮৩৭০ ফিট) উচ্চতায় ক্যাসুয়ারিনার বনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।[২২] বেশকিছু  Imperata cylindrica ও দেখা গেছিলো।

তামবোরার ক্যালডেরার উত্তর প্রান্ত

১৯০৭ সালে তামবোরা পর্বতে পুনরায় বসতি স্থাপন শুরু হয়। ১৯৩০ সালে পর্বতের উত্তর-পশ্চিম ঢালের পেকাত গ্রামে কফির বাগান তৈরি করা হয়।[২৩] ১০০০-২৮০০ মিটার (৩৩০০-৯২০০ ফিট) উচ্চতায় একটি ঘন উপকূলীয় বন গড়ে উঠে।[২৩] ১৯৩৩ সালে কোস্টার ও দে ভুগড এর নেতৃত্বে একটি ওলন্দাজ দল উক্ত উপকূলীয় বনের সন্ধান পান।[২৩] তাদের ভাষ্যমতে, তারা তাদের যাত্রা শুরু করেন একটি "অনেকাংশে বিরান, শুষ্ক ও গরম অঞ্চল হতে" এবং এরপর তারা ঢুকে পড়েন একটি "বৃহৎ জঙ্গল" যার অভ্যন্তরে "বিশাল জঙ্গলী দানব" ছিলো। তারা ১১০০ মিটার (৩৬০০ ফিট) এ মনটান জঙ্গলে প্রবেশ করেন। ১৮০০ মিটারের (৫৯০০ ফিট) উপরে তারা ক্যাসুয়ারিনা গাছ এবং চূড়ায় Anaphalis viscida এবং Wahlenbergia খুজে পান।

১৮৯৬ সালে ৫৬ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে ক্রেস্টেড সাদা-চোখ।[২৪] ১৯৮১ এ আরো ১২ টি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু প্রানীবিদ্যা ভিত্তিক জরিপ পরিচালিত হয়, এবং এর মাধ্যমে আরো কিছু পাখির প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। তামবোরা পর্বতে ৯০ প্রজাতির পাখি আবিষ্কৃত হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা হলুদ টোপরযুক্ত কোকাটু, যুথেরা থ্রাশ, পাহাড়ী ময়না, সবুজ জঙ্গলফাওল এবং রংধনু লরিকীট ইত্যাদি পাখি শিকার করে ও খাচার পাখি হিসেবে বিক্রি করে। খাদ্যের জন্য কমলা-পা স্ক্রাবফাওল শিকার করা হয়। এরূপ পাখি নিধনের জন্য পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সুমবাওয়া দ্বীপে হলুদ টোপরযুক্ত কোকাটু বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে।

১৯৭২ সাল হতে একটি বাণিজ্যিক কাঠ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অত্র এলাকায় কার্যক্রম চালাচ্ছে। কাঠ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানটি ২০০০০ হেক্টর (৪৯০০০ একর) এলাকায় সক্রিয়, যা মোটা এলাকার ২৫%। উপকূলীয় বনটির আরেকটি অংশ শিকারের ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাঠ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষেত্র ও শিকারের ভুমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে বন্যপ্রানীর অভয়ারন্য রয়েছে, যেখানে হরিণ, মহিষ, বুনো শুকর, বাদুড়, উড়ুক্কু শিয়াল, বিভিন্ন প্রজাতির উভচর এবং পাখি দেখা যায়।

২০১৫ সালে উক্ত অভয়ারন্যকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।[২৫][২৬]

ক্যালডেরার তলদেশ[সম্পাদনা]

১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাতের ফলে এই এলাকায় একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠে। এই বাস্ততন্ত্রটি দুর্গম এলাকার জন্য মানবজাতির প্রভাব হতে অনেকাংশেই মুক্ত।

তামবোরা পর্বত পর্যবেক্ষণ[সম্পাদনা]

তামবোরা পর্বতের অবলোহিত আলোকচিত্র (উত্তরদিক বামে)

ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা ১৮১৫ সালের অগ্নূৎপাতের পর থেকে দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। ২০০৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা ২২২ মিলিয়নে পৌছায়।[২৭] শুধুমাত্র জাভা দ্বীপেই ১৩০ মিলিয়ন অধিবাসী রয়েছে।[২৮] সুতরাং ১৮১৫ সালের ন্যায় পুনরায় আরেকটি অগ্নূৎপাতের ফলাফল হবে ভয়াবহ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১৮১৫ সাল অপেক্ষা কয়েকগুন বেশি হবে। উক্ত কারণে ইন্দোনেশিয়ায় আগ্নেয়গিরীর কার্যকলাপ, বিশেষ করে তামবোরা পর্বতের কার্যকলাপ সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ইন্দোনেশিয়ার অগ্নেয়গিরীসমূহ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ডিরেক্টরেট অব ভলকানোলজি এন্ড জিওলজিকাল হ্যাজার্ড মিটিগেশন, ইন্দোনেশিয়া। তামবোরা পর্বতের পর্যবেক্ষণ পোস্ট ডোরো পেটি গ্রামে অবস্থিত।[২৯] তারা সাইসমোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে সাইসমিক ও টেকটোনিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে। যদিও ১৮৮০ সালের পরে সাইসমিক কর্মকাণ্ডে কোন লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন আসেনি,[৩০] তবুও ক্যালডেরার অভ্যন্তরে বিশেষ করে ডোরো আপি টই প্যারাসিটিক কোনের বিরতিহীন পর্যবেক্ষণ পরিচালিত হয়।

ডিরেক্টরেট তামবোরা পর্বতের জন্য একটি দুর্যোগ প্রশমন মানচিত্র প্রনয়ন করেছে। পর্বতটিকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে, বিপদজনক অঞ্চল ও সতর্কতা অঞ্চল।[২৯] বিপদজনক অঞ্চল যেকোন অগ্নূৎপাতের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেঃ পাইরোক্লাসটিক প্রবাহ, লাভা প্রবাহ ইত্যাদি দ্বারা। এই অঞ্চল, ক্যালডেরা ও সংলগ্ন অঞ্চল সহ ৫৮.৭ বর্গ কিলোমিটার (২২.৭ বর্গ মাইল) এলাকা নিয়ে গঠিত। উক্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপনের বিরদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আছে। অন্যদিকে সতর্কতা অঞ্চল অগ্নূৎপাতের ফলে সরাসরি প্রভাবিত হবেনা। সতর্কতা অঞ্চলের আকার ১৮৫ বর্গ কিলোমিটার (৭১ বর্গ মাইল) এবং এটি পাসাংগ্রাহান, ডোরো পেটি, রাও, লাবুয়ান কেনানগা, গুবু পোন্ডা, কাউইন্ডানা টই এবং হড্ডো গ্রাম নিয়ে গঠিত। পর্বতের দক্ষিণে ও উত্তর-পশ্চিমের গুয়ু নদীও সতর্কতা অঞ্চলের অন্তর্গত।[২৯]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

  • মৃতের সংখ্যা অনুসারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকা
  • ইন্দোনেশিয়ায় আগ্নেয়গিরীর সংখ্যা
  • মৃতের সংখ্যা অনুসারে অগ্নূৎপাতের তালিকা

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Stothers, Richard B (১৯৮৪)। The Great Tambora Eruption in 1815 and Its Aftermath। Science। পৃষ্ঠা 1191–1198। 
  2. Degens, Buch, E.T, B (১৯৮৯)। Sedimentological events in Saleh Bay, off Mount Tambora। Netherlands Journal of Sea Research। পৃষ্ঠা 399–404। 
  3. Oppenheimer, Clive (২০০৩)। Climatic, environmental and human consequences of the largest known historic eruption: Tambora volcano (Indonesia) 1815। Progress in Physical Geography। পৃষ্ঠা 230–259। 
  4. Tanguy, Scarth, Ribière, Tjetjep, J-C, A, C, W. S. (১৯৯৮)। Victims from volcanic eruptions: a revised database। Bulletin of Volcanology। পৃষ্ঠা 137–144। 
  5. "Volcanic Eruption That Changed World Marks 200th Anniversary"। ২০১৭-০৪-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  6. "News – URI Today" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  7. Foden, J (১৯৮৬)। The petrology of Tambora volcano, Indonesia: A model for the 1815 eruption। Journal of Volcanology and Geothermal Research। পৃষ্ঠা 1–41। 
  8. "Sumbawa"। ১৫ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 23 april 2012  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  9. "Yahoo! Groups" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৬-০৪-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  10. ""Potential Tourism as Factor of Economic Development in the Districts of Bima and Dompu""। West and East Nusa Tenggara Local Governments। সংগ্রহের তারিখ 14 November 2006.  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  11. "Pusat Vulkanologi dan Mitigasi Bencana Geologi"। ২০০৭-০৯-২৯। Archived from the original on ২০০৭-০৯-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  12. "Peningkatan Status G. Tambora dari Normal ke Waspada"। ২০১১-০৯-০৮। Archived from the original on ২০১১-০৯-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  13. Foden, Varne, J, R (১৯৮০)। The petrology and tectonic setting of Quaternary—Recent volcanic centres of Lombok and Sumbawa, Sunda arc। Chemical Geology। পৃষ্ঠা 201–206। 
  14. igurdsson, H, Carey, S (১৯৮৩)। "Plinian and co-ignimbrite tephra fall from the 1815 eruption of Tambora volcano"। Bulletin of Volcanology। পৃষ্ঠা 243–270। 
  15. ""Geology of Tambora Volcano"."। Vulcanological Survey of Indonesia। ২০০৬-১১-১৬। Archived from the original on ২০০৬-১১-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  16. "Global Volcanism Program | Tambora" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  17. D'Arcy Wood, Gillen (২০১৪)। Tambora: The Eruption That Changed the World। Princeton University Press। 
  18. ""Tambora Historic Eruptions and Recent Activities""। ২০০৭-০৯-২৭। Archived from the original on ২০০৭-০৯-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  19. "BBC NEWS | Science/Nature | 'Pompeii of the East' discovered"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  20. "Zollinger Family History > Heinrich Zollinger" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  21. Heinrich, Zollinger (১৮৫৫)। Besteigung des Vulkans Tambora auf der Insel Sumbawa und Schilderung der Erupzion desselben im Jahr 1815। Winterthur। 
  22. Zollinger (1855) cited by Trainor (2002)
  23. de Jong Boers, Bernice (১৯৯৫)। Mount Tambora in 1815: A Volcanic Eruption in Indonesia and its Aftermath। Indonesia। পৃষ্ঠা 37–59। 
  24. Trainor, C.R. (২০০২)। "Birds of Gunung Tambora, Sumbawa, Indonesia: effects of altitude, the 1815 cataclysmic volcanic eruption and trade"। Forktail.। পৃষ্ঠা 49–61। 
  25. "Mount Tambora National Park Transformed Into New Ecotourism Destination" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  26. "Geckos, moths and spider-scorpions: Six new species on Mount Tambora, say Indonesian researchers" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  27. ""Tingkat Kemiskinan di Indonesia Tahun 2005–2006" (PDF) (Press release) (in Indonesian)" (পিডিএফ)। Indonesian Central Statistics Bureau। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৬। Archived from the original on ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬। 
  28. Calder, Joshua। "Most Populous Islands"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  29. "Pusat Vulkanologi dan Mitigasi Bencana Geologi"। ২০০৭-০৯-২৯। Archived from the original on ২০০৭-০৯-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 
  30. "Pusat Vulkanologi dan Mitigasi Bencana Geologi"। ২০০৭-০৯-২৯। Archived from the original on ২০০৭-০৯-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-১৭ 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  • "Indonesia Volcanoes and Volcanics"Cascades Volcano Observatory। USGS। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০০৬ 
  • "Tambora, Sumbawa, Indonesia"Volcano World। Department of Geosciences at Oregon State University। ১৭ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১৭