মাতৃস্বাস্থ্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মাতৃস্বাস্থ্য একজন মহিলার গর্ভাবস্থা, প্রসাবাবস্থা ও প্রসবোত্তর সময়ের শারীরিক বা স্বাস্থ্য অবস্থা । এই সেবার মধ্যে অর্ন্তভূক্ত রয়েছে- পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের মতে(UNPF)[১], ২০১০ সালে আনুমানিক দুই লক্ষ ঊননব্বই হাজার মহিলা শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায় ও প্রসবাবস্থায় মারা গিয়েছেন। দিনে দিনে এই মাতৃমৃত্যুর হার কমে আসলেও আফ্রিকার কিছু দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে এই হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এর মতে, ২০১৩ সালে গর্ভাবস্থায় বা জন্মসংক্রান্ত কারণে ২ লক্ষ ৮৯ হাজার জন নারী মারা গেছে বলে অনুমান করা হয়েছে।যেহেতু নারীরা পরিবার পরিকল্পনাসহ, প্রসবের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী নিশ্চিতকরণ এবং জরুরীবস্থায় ধাত্রীর যত্ন অর্জন করতে পেরেছে, ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক মাতৃ মৃত্যুহার ১৯৯০ সালে যেখানে প্রতি ১ লক্ষ জীবিত জন্মে ৩৮০ জন ছিল সেখানে ২০১৩ সালে সেই অনুপাত প্রতি ১ লক্ষ জীবিত জন্মে ২১০ এ নেমে এসেছে। এর ফলে অনেক দেশে তাদের মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর হার কমে গেলেও আরো অনেক কিছু করতে হবে। মৃত্যুর এই উচ্চ হার এখনও আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ৮৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে। মায়েদের মৃত্যুর প্রভাব, দুর্বল পরিবার এবং সেই পরিবারের শিশুদের উপর গিয়ে পড়ে। যদি জন্মগ্রহণ করা শিশু বেঁচে থাকে তাহলে সে দ্বিতীয় জন্মদিনে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়।

মাতৃমৃত্যুর হার এবং মারাত্মক মাতৃত্বকালীন মৃত্যু (এসএমএম) উভয়ই "প্রতিরোধের উচ্চ হারের সাথে যুক্ত"।

২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদফতরের যুগ্ম কমিশন মাতৃমৃত্যুর হারকে "সন্ত্রাসী ঘটনা" হিসাবে বর্ণনা করে এবং এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার গুণগত মান নির্ণয় করার জন্য ব্যবহার করে।

মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার প্রতিরোধ করার জন্য চারটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হল- প্রথমত গর্ভকালীন সেবা- মায়ের যত্ন ও গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি বিকাশ সম্পর্কিত সেবা প্রদান করাকে গর্ভকালীন সেবা বলে। দ্বিতীয়তঃ ডাক্তার, নার্স অথবা দক্ষ কর্মী দ্বারা জরুরীবস্থায় সেবা নিশ্চিতকরণ। তৃতীয়তঃ জরুরী যোগাযোগ ব্যবস্থা। সর্বশেষঃ প্রসবোত্তর সেবা- মায়ের প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্পৃক্ত সেবাকে প্রসবোত্তর সেবা বলে। এই সময় রক্তপাত, সেপসিস এবং হাইপারটেনজিকাল ডিসঅর্ডার ঘটতে পারে এবং যা সদ্য জন্মগ্রহণকারী নবজাতকের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। অতএব, প্রসবোত্তর সময়ে একজন স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করা খুবই জোরালোভাবে সুপারিশ করা হয়।

নির্ধারণকারী[সম্পাদনা]

রাষ্ট্রপুঞ্জ জনসংখ্যা তহবিলের (UNFP) তথ্য অনুসারে, গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের সময় মহিলার মৃত্যু ও অক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে । এর সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত একটি মহিলার দারিদ্রতা তার সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক মানের ওপরও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। মৃত্যুর হারের বৈষম্য বা পার্থক্য, সমৃদ্ধ ও দরিদ্র দেশের মধ্যে মহিলার স্বাস্থ্যের অন্যান্য পরিমাপ থেকে বিবেচনা করা হয়। একজন নারীর জীবদ্দশায় গর্ভাবস্থা অথবা প্রসবকালে মৃত্যু ঝুঁকির ফলাফল হিসেবে একটি জরিপে দেখা গেছে, আফ্রিকার সাব সাহারার দেশগুলোর প্রতি ৩৯ জনে ১ জন মারা যাচ্ছে যেখানে শিল্পোন্নত দেশে প্রতি ৪৭০০ জনে ১ জন মহিলা মারা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্যসেবার অভাব[সম্পাদনা]

গর্ভাবস্থায় বা শিশুর জন্মের সময় মাতৃ মৃত্যুর ঝুঁকি উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আফ্রিকার সাব সাহারান দেশগুলোতে ১৭৫ গুণ বেশি। এই ঝুঁকির জন্য গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত অসুস্থতা দায়ী। সেই সাথে জন্মের পরে নেতিবাচক ফলাফল তো আছেই। বলা হচ্ছে যে, দরিদ্রতা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। দারিদ্র্পিড়ীত এলাকায় বসবাসকারী মহিলারা অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসে জড়িত এর মধ্যে যেমন: সিগারেট ও মাদকদ্রব্যে আসক্তি, যেটা নবজাতক প্রসবের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে ঝুঁকিপূর্ণ যা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেনিয়াতে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায় যে দারিদ্র বিদ্বেষপূর্ণ এলাকায় মাতৃ স্বাস্থ্য সমস্যায় অন্তর্ভুক্ত রোগসমূহ হল যেমন :উচ্চ রক্তচাপ, অ্যানিমিয়া, রক্তশূন্যতা, ম্যালেরিয়া, অকালশ্রম, দীর্ঘায়িত জটিল শ্রম ইত্যাদি। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রসব-পূর্বের যত্ন গ্রহণের সম্ভাবনা কম। বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিক এবং পরিবহনের অভাব নারী ও কিশোরীদের যথোপযুক্ত প্রাক-জন্মগত যত্ন নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রসব-পূর্ববর্তী যত্নের পরিমাণের সাথে আয়ের দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে। মালিতে পরিচালিত মাতৃস্বাস্থ্য সেবা নামক একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত নারীরা শহুরে নারীদের তুলনায় প্রসব পূর্ববর্তী সেবা কম পায়। উপরন্তু, বিশ্লেষকরা পরিবহনের অভাব, প্রসবপূর্ব সেবা এবং প্রসবকালীন সেবার মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।

এইচআইভি/এইডস[সম্পাদনা]

মাতৃ এইচআইভির হার সারা বিশ্বে ১% থেকে ৪০% এর মধ্যে পরিবর্তিত হয় যেখানে আফ্রিকান এবং এশীয় দেশগুলিতে এর হার সর্বোচ্চ। এইচআইভি / এইডস প্রসবপূর্ব সময়, প্রসবের সময়, কিংবা শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যদি একজন মা এইচআইভি / এইডস ভাইরাসে সংক্রমিত হয়, তবে গর্ভাবস্থায় যথাযথ চিকিৎসা না করালে তার গর্ভে থাকা শিশুটির ২৫% সম্ভাবনা থাকে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার অন্যদিকে, যদি একজন মা গর্ভাবস্থায় যথাযথ চিকিৎসা করায়, তবে ৯৮% সম্ভাবনা রয়েছে যে তার শিশু সংক্রমিত হবে না।

ইউনিসেফের (UNICEF)[২] মতে, গত দশকে পিতা-মাতা থেকে সংক্রমিত এইচআইভি / এইডস-এর কারণে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সেইসব দেশে যেখানে শিক্ষার হার খুবই কম এবং দারিদ্রের উচ্চ কষাঘাত বিদ্যমান । গর্ভাবস্থায় এইচআইভি / এইডস মায়েদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ যক্ষ্মা (টিবি) এবং / অথবা ম্যালেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি।

মাতৃত্বকালীন ওজন[সম্পাদনা]

গর্ভাবস্থায় ওজন হ্রাস ১১-২০ পাউন্ড (৫-৯ কেজি) সাধারণত মা এবং শিশু উভয়ের জন্য ভালো। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা মাতৃস্বাস্থ্যের উপর এমনকি গর্ভাস্থ শিশুর উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের জন্য স্থূলতা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসব স্থূল মায়েরা গর্ভাবস্থায় ওজন (কমপক্ষে ১০ পাউন্ড বা ৪.৫ কেজি) হ্রাস করে তারা আসলে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। অপরদিকে যেসব মায়েরা তাদের ওজন বাড়ায় তারা আসলে তাদের নিজেদের ঝুঁকি বাড়ায়।

মৌখিক স্বাস্থ্য[সম্পাদনা]

মাতৃত্বের মৌখিক স্বাস্থ্য মা এবং তার অনাগত সন্তান উভয়ের সুস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে দেখা গিয়েছে। ২০০০ জন সার্জন জেনারেলের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, একজন ব্যক্তির সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মৌখিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে। মৌখিক স্বাস্থ্য[৩] বিশেষ করে বংশগতির সময় এবং শিশুর ভবিষ্যত উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। মৌখিক স্বাস্থ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা মা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই উপকারী। উপরন্তু, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ভাল মৌখিক স্বাস্থ্যের বোঝার বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাব তাদের এবং তাদের সন্তানদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অতএব, মৌখিক স্বাস্থ্যের তাৎপর্য সম্পর্কে একজন মাকে শিক্ষিত করা খুবই জরুরী। উপরন্তু, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে পারিবারিক অনুশীলনকারী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে সহযোগিতা এবং সমর্থন, মাতৃত্বের মৌখিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগগুলি মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। ২০০৭ সালে, নেসাউয়ের কাউন্টিতে, কম আয়ের গর্ভবতী নারীদের মৌখিক যত্ন প্রদানের জন্য মাতৃত্বকালীন ওরাল হেলথ প্রজেক্ট তৈরি করা হয়েছিল। এরপর, এই প্রোগ্রামটি ২,০০০ জনেরও বেশি গর্ভবতী মহিলাদের চিকিৎসা করেছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই মাড়ি এবং দাঁতে সমস্যা ছিল।

সুবিধা এবং প্রভাব[সম্পাদনা]

ইউএনএফপিএর (UNFP) মতে, আধুনিক পরিবারের পরিকল্পনা এবং মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২,৮৭,০০০ থেকে শুরু করে ১,০৫,০০০ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। অতএব, পরিবার পরিকল্পনা এবং উন্নত মাতৃ স্বাস্থ্যসেবাতে বিনিয়োগে অনেক সুবিধা রয়েছে যা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাবে। একটা পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, “কোন শিক্ষা ছাড়া নারীদের গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন সময়ে মারা যাওয়ার হার, যারা মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়েছে তাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি"। প্রমাণ দেখায় যে, যারা শিক্ষিত তাদের শিশুগুলাও স্বাস্থ্যবান ।

গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থায় মৌখিক স্বাস্থ্য ও রোগের সুরক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণ একটি মহিলার স্বাস্থ্যের মান রক্ষা করে। এছাড়াও, মায়ের থেকে শিশুর দেহ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হ্রাসের সক্ষমতা রয়েছে। গর্ভাবস্থার পাশাপাশি, একজন মহিলার শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আসে। পরিবর্তনগুলি হল হরমোনের হ্রাস-বৃদ্ধি যা মৌখিক সংক্রমণের সম্ভাব্যতাকে বাড়িয়ে তোলে। গর্ভাবস্থায় গর্ভাশয়ের মৃদু প্রদাহ,"গঞ্জেভিটিস" নামে বেশ প্রচলিত, যদি রোগটির যথাযত চিকিৎসা না করানো হয় তবে পিরিওডিকাল রোগ হতে পারে।

সহযোগিতা ও শিক্ষা[সম্পাদনা]

মৌখিক স্বাস্থ্যের তাৎপর্য দৃশ্যত। এমন অনেক মহিলায় আছেন যারা গর্ভাবস্থার আগে, গর্ভাবস্থার সময় অথবা গর্ভাবস্থার পরেও মৌখিক রোগের সুস্পষ্ট লক্ষণগুলি প্রকাশ পাওয়া স্বত্বেও ডেন্টাল পরিষেবাগুলি গ্রহণ করেন না। গর্ভবতী নারীদের ডেন্টাল সেবা না নেওয়ার পেছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে এরমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ভূমিকা এবং নারীর স্বকীয়তাও রয়েছে। একটি সাধারণ ভুল ধারণা আছে যে, গর্ভবতী অবস্থায় দাঁতের সেবা গ্রহণ করা নিরাপদ নয়। প্রথম এবং সর্বাগ্রে, গর্ভবতী মহিলাদের কাছে ডেন্টাল পরিষেবাগুলির প্রভাব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করার প্রয়োজন। একটি ঐক্যমত্য রয়েছে যে মৌখিক রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত উপকারী এবং গর্ভবতী মহিলাদের মৌখিক যত্ন তাদের গর্ভস্থ সন্তানের উপর কোন ধরনের ক্ষতিসাধন করে না।

শিশু স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের প্রভাব[সম্পাদনা]

জন্মগত স্বাস্থ্য[সম্পাদনা]

জন্মপূর্বকালীন যত্ন প্রাথমিক মাতৃ স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন মায়ের কমপক্ষে চারটি প্রসবোত্তর পরিদর্শন লাভের সুপারিশ করা হয়, যেখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মী অসুস্থ স্বাস্থ্যের লক্ষণগুলি পরীক্ষা করতে পারে - যেমন কম ওজন, অনিয়ম বা সংক্রমণ - এবং ভ্রূণের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ ইত্যাদি। এই পরিদর্শনের সময়, নারীদের তাদের স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়। জরুরী অবস্থায় করণীয় বিষয় সম্পর্কে তারা একটি জন্ম পরিকল্পনা গড়ে তোলার আলোচনা করতে পারে। দারিদ্র্য, অপুষ্টি শিশুর আচরণগত সমস্যাগুলির কারণ হতে পারে। অন্য কথায়, যদি একজন মা প্রসবপূর্ব সময়ে (যখন তিনি গর্ভবতী হয়) অনুকূল স্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে শিশুর স্বাস্থ্য বা বিকাশগত সমস্যাগুলির সম্ভাবনা বেশি হয় এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়। গর্ভধারণ এবং জন্মের পর মায়ের ভ্রূণ / ভ্রূণের জন্য পরিবেশটি সুপ্রতিষ্ঠিত। “টেরাটোজেন” এমন একটা নেগেটিভ এজেন্ট যা একটি শিশুর জন্মদানকালে নেতিবাচক এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের আমূল পরিবর্তন করতে পারে। “টেরাটোজেন” ভ্রূণের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা নির্ভর করে টেরাটোজেনের পরিমাণ, জেনেটিক সংবেদনশীলতা এবং ছড়িয়ে পড়ার উপর।

গর্ভাবস্থায় স্ট্রেটোমোমাইসিন, ট্যাটাসাস্প্লিন, কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, প্রোগেস্টিন, সিন্থেটিক ইস্ট্রোজেন, অ্যাকিউটেন এবং কাউন্টার ওষুধ হিসেবে ডায়েট পিলস গ্রহণ করা হয় যা ভ্রূণ বিকাশে বাঁধাদান করে। উপরন্তু, অ্যাসপিরিনের উচ্চ ডোজগুলি মা ও ভ্রূণের রক্তপাতের কারণ, যদিও কম ডোজ অ্যাসপিরিন সাধারণত ক্ষতিকারক হয় না। গর্ভাবস্থায় যে মায়েরা হেরোইন ব্যবহার করে এমন নবজাতকের জন্মকালে প্রায়ই উপসর্গ দেখা দেয় এবং শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে মনোযোগের সমস্যা ও স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় মেথাম্ফেটামিন এবং কোকেনের মতো উত্তেজক ব্যবহার করা শিশুর জন্য কয়েকটি সমস্যার কারণ যেমন, কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়া, জ্ঞানীয় বিকাশে বিলম্ব এবং শৈশব জুড়ে আচরণগত সমস্যা। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ চাইল্ড এন্ড কিউন্যোলস সাইকিয়াট্রি, ৬ বছর বয়সী শিশুদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করে দেখেছে যে, গর্ভাবস্থায় যে মায়েরা ধূমপান করেছে তাদের শিশুরা, গর্ভাবস্থায় যে মায়েরা ধূমপান করেনি তাদের শিশুদের থেকে কম বুদ্ধিসম্পন্ন।

গর্ভাবস্থায় ধূমপান সন্তানের স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থায় ধূমপানের প্রচলিত ফলগুলি হল অপরিপক্ক শিশুর জন্ম, কম ওজনের শিশু জন্ম, ভ্রূণ এবং নবজাতক মৃত্যু, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা এবং হঠাৎ শিশু মৃত্যু (SIDS)[৪], পাশাপাশি স্বল্প বুদ্ধি, মনোযোগের ঘাটতি এবং অন্যান্য আচরণগত সমস্যা। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্যান্সার প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় যেসকল মহিলারা ধূমপান করেছে তাদের শিশুদের নন-হডকিন লিম্ফোমার ঝুঁকি ২২% বেড়েছে।

শিশু জন্ম[সম্পাদনা]

জিনগত হার্পস প্রসবের সময় বার্থ কেনালের মধ্য দিয়ে শিশুর দেহে প্রবেশ করে। গর্ভাবস্থায় যে মা ভাইরাসে সংক্রমিত থাকে এবং সংক্রমিত সেই বার্থ কেনাল দিয়ে জন্মানো শিশুর ২৫% এর মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে এমনকি এক-তৃতীয়াংশ শিশুর মৃত্যুও ঘটে। আবার বাচ্চা প্রসবের সময় মায়ের শরীরে থাকা এইচআইভি / এইডস বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। উন্নত দেশগুলিতে মায়েরা প্রসবের সময় বার্থ কেনাল সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে বাচ্চা জন্ম দিয়ে থাকেন, তবে এই বিকল্পটি সবসময় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পাওয়া যায় না।

প্রসবোত্তর সময়[সম্পাদনা]

বিশ্বব্যাপী, প্রতিবছর ১৩৬ মিলিয়ন নারীর মধ্যে ৮ মিলিয়নের বেশি নারী সন্তান প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ভোগে। এই অবস্থাকে-ডাক্তারি ভাষায় পোস্টপ্যার্টাম হেমোরেজ (পিপিএইচ)[৫] বলে অভিহিত করা হয়। প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু সামঞ্জস্যহীনভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির নারীদের উপর প্রভাব ফেলে। গর্ভধারন সম্পর্কিত বিভিন্ন কারণে মারা যায় এমন প্রত্যেক মহিলার জন্য, আনুমানিক ২০-৩০টি গুরুতর জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। যারা এই ধরনের জটিলতায় বেঁচে থাকে তাদের প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী পুনর্বাসনের প্রয়োজন পড়ে এবং স্থায়ীভাবে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদিও এই জটিলতার অনেকগুলি অনির্দেশ্য উপরন্তু প্রায় সব জটিলতাগুলিই চিকিৎসা যোগ্য । প্রসবোত্তর সময়ে, অনেক মা তাদের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান। বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে এইচআইভি / এইডস ছড়িয়ে পড়া উন্নয়নশীল দেশ, যেমন আফ্রিকার দেশগুলোতে একটি বিশাল সমস্যা। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সুপারিশ অনুযায়ী,সন্তান জন্ম দেওয়ার পর দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। আবার আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস এবং আমেরিকান একাডেমী অফ ফ্যামিলি ফিজিসিইয়ান্স সুপারিশ করে যে, মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর কমপক্ষে প্রথম ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়াবে। যেসব শিশুরা সুস্থ মায়ের (এইচআইভি / এইডস দ্বারা সংক্রামিত নয়) বুকের দুধ খেয়ে থাকে এমন শিশুরা হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্ট্রেপ্টোকোক্কাস নিউনয়ি, ভিবরিও কলেরা, এসচারিচিয়া কোলাই, গাইয়ার্ডিয়া লেম্বলিয়া, গ্রুপ বি স্ট্রেটোকোকি, স্ট্যাফিলোকক্কাস এপিডার্মিডিস, রোটাই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয় না।

মায়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব[সম্পাদনা]

মাতৃত্বের স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি যেমন শিশু প্রসবের সময় জটিলতা যা মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর কারণ না। যে মহিলাটি শিশু প্রসবকালে মারা যায় গড়পড়তায় তার জন্য প্রায় ২০ টি সংক্রমণ, আঘাত বা অক্ষমতা দায়ী থাকে।

উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রায় ৫০% জন্ম দেওয়া মাতাকে সাহায্য করার জন্য কোনও দক্ষ কর্মী থাকে না এবং এই হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খুবই উচ্চতর। সাব-সাহারান আফ্রিকাতে নারী সাধারণত ঐতিহ্যগত জন্মদানকারীর (টিবিএ) উপর নির্ভর করে, যাদের সামান্য বা কোনও আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণ নেই। কিছু দেশ এবং বেসরকারী সংস্থা মাতৃমৃত্যু স্বাস্থ্য বিষয়গুলিতে মা এবং শিশুদের মধ্যে ভাল স্বাস্থ্য ফলাফলের সম্ভাবনা উন্নত করার জন্য TBAs দের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার (MMR)[সম্পাদনা]

Maternal Mortality Rate [৬] মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার (এমএমআর) হল গর্ভাবস্থায় বা তার পরিচালন সম্পর্কিত কোন প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রতি ১ লক্ষ জীবিত জন্মে বার্ষিক মহিলা মৃত্যুর হার (দুর্ঘটনাজনিত বা আনুষ্ঠানিক কারণ ব্যতীত)[৭]

দিনে দিনে বিশ্বে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার (MMR) কমছে, ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৫৯% হ্রাস পেয়েছে এবং আফ্রিকার ২৭%।.[৮][৯]

উন্নয়নশীল দেশে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার (MMR)[সম্পাদনা]

মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ দূর্বল মাতৃস্বাস্থ্য চরম দারিদ্র্যের একটি সূচক। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মানব উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট তামের ম্যানুয়ালান অ্যাটিংক এর মতে, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু দারিদ্র্যের কারণে হয়ে থাকে। সন্তান প্রসবের খরচ খুব দ্রুত একটি পরিবারের আয় হ্রাস করতে পারে, এমনকি এটি আরও আর্থিক অসুবিধা নিয়ে আসে। অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, প্রজনন বয়সের মহিলাদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ হল, গর্ভাবস্থা এবং শিশুজন্মের জটিলতা। প্রায় প্রত্যেক মিনিটেই একজন নারী শিশু প্রসবের জটিলতা থেকে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৫ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এইচআইভি / এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের পর বিশ্বব্যাপী নারীর মৃত্যুর চতুর্থ কারণের জন্য দরিদ্র মাতৃত্বকালীন অবস্থাকে দায়ী করে থাকে। অধিকাংশ মাতৃমৃত্যু (রোগ থেকে নয়) বিভিন্ন ধরনের জৈবনিক কারণে হয়ে থাকে, সেগুলা খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায় এবং সেটি উন্নত দেশগুলিতে নির্মূল করা সম্ভবপর হয়েছে। যেমন প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ এর ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বে ৩৪% মাতৃমৃত্যু ঘটে, যেখানে মাত্র ১৩% উন্নত দেশের মায়েদের মৃত্যু ঘটছে। যদিও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসচেতনতা, উন্নত দেশগুলিতে মাতৃমৃত্যু একটি বিরল ঘটনা সৃষ্টি করেছে, যেখানে মাতৃমৃত্যুর হার মাত্র ১%। এই জটিলতাগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বব্যাপী মারাত্মক হতে পারে কারণ নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য একক সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নত দেশে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার (MMR)[সম্পাদনা]

বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশে মাতৃমৃত্যুর হার অনুরূপ ছিল। যেহেতু অধিকাংশ মাতৃমৃত্যু এবং আঘাত প্রতিরোধযোগ্য, তাই সেগুলো উন্নত বিশ্বে ব্যাপকভাবে নির্মূল করা হয়েছে। শিল্পায়িত বিশ্বের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার সর্বোচ্চ। ২০১৬ সাল থেকে, প্রোপাবলিকা (ProPublica)[১০] এবং এনপিআর (NPR)[১১] যুক্তরাষ্ট্রের মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণগুলি অনুসন্ধান করছে। তারা রিপোর্ট করেছে যে "প্রাক-বিদ্যমান অবস্থার কারণে, চিকিৎসা সংক্রান্ত ত্রুটি এবং যত্নের সাথে অসামঞ্জস্যতার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন মায়েদের জীবনের ঝুঁকির জটিলতার হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।"[১২] সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন[১৩] এর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর, ৪০ লক্ষ নারীদের মধ্যে ৫০ হাজারেরও বেশি সন্তান প্রসবের সময় বিপজ্জনক এবং এমনকি জীবন-হুমকির জটিলতার অভিজ্ঞতা লাভ করে। এর মধ্যে প্রতি বছর গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবকালীন সময়ে ৭০০ থেকে ৯০০ জন মহিলা মারা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৩ সালে গুরুতর মাতৃত্বকালীন রোগের হার প্রতি ১০ হাজারে ৪২.৫ থেকে ১৪৪ পর্যন্ত বেড়েছিল।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "মার্তৃত্বকালীন সেবা"জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল 
  2. "UNICEF"UNICEF 
  3. "ওরাল হেলথ"উইকিপিডিয়া 
  4. "Sudden Infant Death Syndrome"Mayo Clinic 
  5. "Postpartum Hemorrhage"stanford children's health 
  6. "মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার"world health organization 
  7. Country Comparison: Maternal Mortality Rate ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে in The CIA World Factbook. Date of Information: 2010
  8. "Maternal mortality ratio per 100,000 live births by WHO region, 1990–2008"। World Health Organization। ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  9. UN 2015
  10. "ProPublica"Wikipedia 
  11. "NPR"Wikipedia 
  12. Ellison, Katherine; Martin, Nina (ডিসেম্বর ২২, ২০১৭)। "Severe Complications for Women During Childbirth Are Skyrocketing — and Could Often Be Prevented"। Lost mothers। ProPublica। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ২২, ২০১৭ 
  13. "CDC"Wikipedia