বেন্‌যাইতেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মাথায় তোরিই বিশিষ্ট বেন্‌যাইতেনের মূর্তি।

বেন্‌যাইতেন (, ) একজন জাপানি বৌদ্ধ দেবী, যাঁর রূপকল্পনা করা হয় হিন্দু দেবী সরস্বতীর অনুসারে।[১] জাপানে বেন্‌যাইতেনের পুজো শুরু হয় খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে। বৌদ্ধ গ্রন্থ সোনালী আলোর সূত্রের চীনা অনুবাদ মারফত এই দেবীর পরিচয় ঘটে। অনুবাদ গ্রন্থটির একটি অংশ বেন্‌যাইতেন সম্পর্কিত। পদ্ম সূত্র গ্রন্থেও তাঁর উল্লেখ আছে। সরস্বতীর হাতে যেমন বীণা থাকে, তেমনি বেন্‌যাইতেনের হাতেও একটি বিওয়া বা ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাঁশি দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে বেন্‌যাইতেন এক মিশ্র বিশ্বাসের দেবী যাঁর মধ্যে বৌদ্ধশিন্তো দুই ধর্মেরই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

ভারত থেকে জাপানে আগমন[সম্পাদনা]

বেন্‌যাইতেন মন্দির, ইনোকাশিরা উদ্যান, টোকিও।

সংস্কৃতে যাঁকে সরস্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে[২] সেই বেন্‌যাইতেন দেবী পঞ্চভূতে যা কিছু প্রবহমান বা প্রবাহের আকারে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়, সেই সমস্ত উপাদানের দেবী, যথা জল, সময়, শব্দ ও বাক্য, সঙ্গীত এবং জ্ঞান। প্রাথমিকভাবে তাঁর নাম লেখার জন্য যে চিত্রাক্ষরগুলি ব্যবহার করা হত তাতে চীনা ভাষায় তাঁর নাম "বিয়াংকাইতিয়ান" এবং জাপানিতে "বেন্‌সাইতেন" (辯才天)। এই উচ্চারণ অনুযায়ী বাগ্মিতার দেবী হিসেবে তাঁর ভূমিকাকে বড় করে দেখা হত। সোনালী আলোর সূত্র গ্রন্থটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে জাপানে বেন্‌যাইতেন একজন রক্ষয়িত্রী দেবী হিসেবে পূজিত হতে থাকেন; প্রথমে রাষ্ট্রের এবং পরবর্তীকালে জনসাধারণেরও রক্ষয়িত্রী হিসেবে তাঁকে কল্পনা করা হতে থাকে। অবশেষে চীনা-জাপানি চিত্রাক্ষরে তাঁর নাম বেন্‌যাইতেন (弁財天) হয়ে উঠলে তাঁকে "সৌভাগ্যের সপ্তদেবতার" (ফুকুজিন) অন্যতম হিসেবে কল্পনা করা শুরু হয়। এই সময় থেকে আর্থিক নিরাপত্তাও তাঁর প্রভাবাধীন বলে গণ্য হয়। কখনও কখনও তাঁকে বেন্‌তেন বলা হলেও এই নামটি আসলে ব্রহ্মার। বেন্‌যাইতেন্‌ন্যো (弁才天女) নামটি অধিক নিশ্চিত, কারণ "তেন্‌ন্যো" (天女) অনুসর্গের অর্থ 'দেবী'।

সাত জন ফুকুজিনের মধ্যে কিশ্‌শোওতেন্‌ন্যো দেবীকে ধরা হলে এবং অন্যতম ফুকুজিন দাইকোকু-কে স্ত্রী মূর্তিতে কল্পনা করা হলে হিন্দু ত্রিশক্তির সকলেই ফুকুজিন হিসেবে প্রতিভাত হন।

ঋগ্বেদে (৬.৬১.৭) সরস্বতী ত্রিমুণ্ডবিশিষ্ট বৃত্রাসুরকে বধ করেন, বৃত্রাসুরের অপর নাম ছিল "অহি" বা সাপ। এই তথ্য জাপান ও চীনে সরস্বতী/বেন্‌যাইতেনের সাথে সাপ ও ড্রাগনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অন্যতম সম্ভাব্য কারণ। জাপানে বহু স্থানে বেন্‌যাইতেনের মন্দির আছে,[৩] যেমন সাগামি উপসাগরের এনোশিমা দ্বীপ, বিওয়া হ্রদের চিকুবু দ্বীপ এবং সেতো অন্তর্দেশীয় সাগরের ইৎসুকুশিমা দ্বীপ। ১০৪৭ খ্রিঃ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কোওকেই (皇慶) এনোশিমার মন্দিরগুলির একটি ইতিহাস রচনা করেন। এই গ্রন্থ অনুযায়ী বেন্‌যাইতেন হলেন ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থিত শীতল হ্রদ মুনেৎসুচি-তে (無熱池, সংস্কৃত অনবতপ্ত) অধিষ্ঠানরত ড্রাগন রাজার তৃতীয় কন্যা। এটি বৌদ্ধ মত।

এর চেয়েও প্রাচীন বৌদ্ধ নথিপত্রে বিভিন্ন ধূমকেতুর সঙ্গে বেন্‌যাইতেনের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা দেখা যায়। যেমন, ৫৫২ ও ৫৯৩ খ্রিঃ আবির্ভূত ধূমকেতুটিকে বেন্‌যাইতেনের চিহ্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই সমস্ত তথ্য থেকে বোঝা যায় ভারত থেকে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও পুরাণ বেন্‌যাইতেনের মত দেবতাদের কেন্দ্র করে ষষ্ঠ শতাব্দীর অনেক আগে থেকেই জাপানে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কামি হিসেবে বেন্‌যাইতেন[সম্পাদনা]

বেন্‌যাইতেন শিন্তো ধর্মের একজন স্ত্রী কামি। কামি রূপে তাঁর নাম ইচিকিশিমা-হিমে-নো-মিকোতো (市杵島姫命?)।[৪] তেন্দাই বৌদ্ধধর্মে অন্য এক কামি উগাজিনের সারবত্তা হিসেবে তাঁর উল্লেখ আছে। বেন্‌যাইতেনের মাথার উপর ক্ষেত্রবিশেষে তোরিই সমেত উগাজিনের পুতুল রাখা হয়।[৫] এই রূপে তাঁর নাম উগা বেন্‌যাইতেন বা উগা বেন্‌তেন। শিন্তো তীর্থের প্রবেশপথের নাম বেন্‌তেন-দোও বা বেন্‌তেন-শা (弁天社)। কখনও কখনও সমগ্র তীর্থও বেন্‌যাইতেনকে উৎসর্গ করা হয়, যেমন কামাকুরার যেনারাই বেন্‌যাইতেন উগাফুকু তীর্থ ও নাগোয়্যার কাওয়াহারা তীর্থ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Catherine Ludvik (২০০১), From Sarasvati to Benzaiten, পিএইচ.ডি. গবেষণা সন্দর্ভ, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার জাতীয় গ্রন্থাগার; PDF ডাউনলোড
  2. Saraswati meets Buddha, শৈলজা ত্রিপাঠী, দ্য হিন্দু, ২১শে মার্চ, ২০১৬
  3. T. Suzuki (1907), সৌভাগ্যের সাত ভগবান, দ্য ওপেন কোর্ট, ১৯০৭ (7), 2
  4. Bocking, Brian (১৯৯৭)। A Popular Dictionary of Shinto - 'Benzaiten'। Routledge। আইএসবিএন 978-0-7007-1051-5 
  5. Itō, Satoshi: "Ugajin". শিন্তো বিশ্বকোষ, কোকুগাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়, সংগৃহীত August 15, 2011