সিলেট অঞ্চলে উপাসিত লৌকিক দেব-দেবী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সিলেট অঞ্চলে উপাসিত লৌকিক দেব-দেবী বলতে বুঝানো হয় সিলেটের স্থানীয় পর্যায়ে ধর্ম ও অন্যান্য ভেদাভেদ নির্বিশেষে একই পেশাজীবিদের মধ্যে পূজিত কিছু নির্ধারিত দেব-দেবীগণকে। সিলেট, উত্তর পূর্ব বাংলাদেশের একটি প্রধান শহর এবং আটটি বিভাগের মধ্যে একটি।বৃহত্তর সিলেটি সমাজভুক্ত অঞ্চল যেমন ভারতের বরাক উপত্যকার অন্তর্গত করিমগঞ্জ জেলা, হাইলাকান্দি জেলা ও কাছাড় জেলাতেও এই লৌকিক দেব-দেবীরা পূজিত হন।

দেব-দেবীগণের তালিকা[সম্পাদনা]

সিলেট অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবীর মধ্যে ৭ জন প্রধান;[১] যারা নিম্নরূপে বর্ণিত:

  1. রূপসী দেবী;
  2. বাদশা;
  3. কালাচাঁদ;
  4. সন্ন্যাসি বাবা;
  5. রাখাল;
  6. ডহর বিষহরী;
  7. কুলা দেবী
  8. সন্তোষী

সংক্ষিপ্ত বিবরণ[সম্পাদনা]

রূপসী দেবী

শাস্ত্রীয় ষষ্টি দেবী এবং সুবচনী দেবীর সাথে প্রচুর সাদৃশ্যযুক্ত। এই দেবী শুভকর্ম যেমন- বিবাহ, নারীর উর্বরতা, শিশু জন্ম ও শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের সাথে সংযুক্ত। শেওড়া গাছ(যাকে স্থানীয় সিলেটি বাংলায় রুপসী গাছ বলা হয়) হল দেবীর আবাস এবং কারো বিবাহের পূর্বে কিংবা কোনও শিশু জন্মের এক মাস অতিবাহিত হবার পরের ব্রত দিবসে কিংবা শিশুর অন্নপ্রাশনের আগে পূজারিনী স্বয়ং বেজোড় সংখ্যার ব্রতী সহ গাছের গোড়ায় কিংবা কলা গাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি ভেলায় (স্থানীয় নাম: ভেরুয়া) রুপসী গাছের ডাল স্থাপন করে এই পূজা সম্পন্ন করেন। সাধারণত সধবা নারীরাই রুপসী পূজার ব্রতী হয়ে থাকেন এবং ফল, নৈবদ্য ইত্যাদি নিরামিষ দ্রব্যর ভোগ নিবেদন করা হয়। ইদানীং ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারাও এই পূজা করানো হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে পূজিত বুড়ি মা/বুড়ি ঠাকুরানী/বুড়ি-গোসাঈনীর সাথেও এনার সাদৃশ্য বিদ্যমান।

বাদশা

এই মহা শক্তিশালী পুরুষ দেবতা বন, জঙ্গল, টিলা-পাহাড়, জলাভূমি ইত্যাদির রক্ষাকর্তা হিসেবে সন্মানিত এবং তাঁর আরাধনা নিম্নবর্গীও হিন্দু সমাজ এবং গ্রাম্য মুসলিম সমাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষত নতুন রাস্তা তৈরির সময়, বনজঙ্গল কেটে কাঠ, বাঁশ, লাল মাটি, বালু ইত্যাদি সংগ্রহর আগে, মাছ ধরবার মরশুমের পূর্বে কিংবা বাড়ী তৈরি আরম্ভ করবার আগে উভয় সম্প্রদায় কর্তৃক বাদশাকে সিন্নি চড়ানো হয়ে থাকে। সময় বিশেষে গাঞ্জা এবং শোল অথবা গজার মাছ পুড়িয়েও ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। অমিত শক্তিশালী এই দেবতার দয়া হলে অপরিসীম ধন ও শক্তিলাভ সম্ভব বলে কথিত। এই দেবের কোনও মন্দির স্থাপন করা হয় না এবং বনাঞ্চলের কোনও প্রাচীন বনস্পতিতে(বট/ অশথ্ব/ চাম কাঁঠাল)ওনার আবির্ভাব উপলব্ধি করে তার তলায় বাদশার থান/পীঠ/মোকাম স্থাপন করে ভোগ নৈবদ্য নিবেদন করা হয়। কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা তাঁর পূজা নিষ্পন্ন করা হয় না এবং পূজকরা নিজেরাই কাঁচা গরুর দুধ, ফল ইত্যাদি মোকামে ঢেলে দিয়ে যান।হিন্দু দেবতা ভৈরবের সাথে বাদশার সামঞ্জস্য লক্ষণীয়।

কালাচাঁদ

এই দেবতা ধানক্ষেত, পশু, ফল বাগান ইত্যাদির রক্ষাকর্তা। তাঁর কোনও মূর্তি নেই এবং খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারণত কোনও গাছের নিচে “কালাচাঁদের থানে” একটি পাথর কে প্রতিভূ করে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিনা তাঁর পূজা করা হয়। কাঁচা গোদুগ্ধ, ফল ইত্যাদি নৈবদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। মনে করা হয় কালাচাঁদ হলেন প্রাচীন অনার্য শিবের কোন পরিবর্তিত রূপ।

সন্ন্যাসি বাবা

গ্রাম রক্ষাকারি দেবতা (গ্রাম্য দেবতা)বিশেষ যাকে গ্রামের ভেতরেই কোন সুপ্রাচীন বনস্পতির নিচে অবস্থিত পীঠে (বাবার থান) কাঁচা গোদুগ্ধ, ফল ইত্যাদি নৈবদ্য প্রদান করে পূজা করা হয়। পূজার সময় হরিনাম কীর্তন করা হয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিনাই তার পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সন্ন্যাসি বাবাও মনে হয় শিবের কোন পরিবর্তিত রূপ।

রাখাল

বাদশার মত রাখালদেবেরও সংযোগ বন, জঙ্গল, টিলা-পাহাড়, জলাভূমি ইত্যাদির সাথে। তাঁর কোনও রূপ নেই এবং সুবিশাল প্রাচীন বনস্পতির তলাতেই তাঁর পীঠ(থান) স্থাপিত করে পূজা নিস্পন্ন করা হয়। ভেজানো বীরন চাল, কাঁচা গো-দুগ্ধ, কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে নৈবদ্য প্রদত্ত হয়। জেলে সম্প্রদায় মাছ ধরবার মরশুমের প্রারম্ভেই তাঁর পূজার আয়োজন করে থাকেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই অত্যন্ত সন্মানের এই দেবতার কৃপা হলে অমিত শক্তি এবং সম্পদের অধিকারী হওয়া সম্ভব এই বিশ্বাস বিদ্যমান।

ডরাই বিষহরী/ডহর বিষহরী

এই দেবী সাধারণত জেলে সম্প্রদায়ের আরাধ্য। চতুর্ভুজা নগ্না কাঁচা হলুদ বর্ণের এই দেবী নাগের তৈরি বাজুবন্ধ, কঙ্কন, মল ইত্যাদির দ্বারা আভুষিত এবং নটরাজ ভঙ্গিমায় কচ্ছপের ওপরে দণ্ডায়মান। অনেক ক্ষেত্রে একজন গুরমির (এক রকম নপুংসক নর্তক)পৌরোহিত্বে তাঁর পূজা করা হয় গুপ্তভাবে। মাছধরার সময় ডহর এবং ঘূর্ণি জলস্রোত থেকে নৌকা এবং নৌকার সাওয়ারিদের প্রানরক্ষা, অধিক মৎস শিকার ইত্যাদির কামনা করে এই দেবীর পূজা করা হয়। কথিত যে সন্তানলাভের জন্য, সন্তানের প্রানরক্ষা এবং সন্তানকে বিভিন্য ভয়ভীতি থেকে রক্ষা করবার জন্য তাঁর পূজা করলে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। মনে হয় যে সর্প দেবী শ্রীমনসার কোনও প্রাচীন অথবা বিবর্তিত রূপ হলেন ডরাই বিষহরী। (ডরাই<ডহর আই; আই শব্দের অর্থ মা। অর্থাৎ ডহরের অধিষ্ঠাত্রী মা)

কুলা দেবী/কুলা মা

কোনও বিবাদিত প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য কুলা দেবীর আরাধনা করা হয়। একজন ব্যক্তি একটি নতুন বাঁশের কুলায় সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে কুলাটিকে কোনও সূচাগ্র লোহার ছুরির সাহাজ্যে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখেন এবং পান, সুপারী ও বাতাশা দিয়ে কুলা দেবীকে আহ্বান করে বিবাদিত প্রশ্নটি করেন। যেই পক্ষের দিকে কুলা ঘুরে যাবে, ধরে নেওয়া হয় যে সেই পক্ষ জয়ী হয়েছেন।

সন্তোষী মা :

সন্তোষী মা (ইংরেজি:Santoshi Mata) হিন্দুধর্ম-এর একজন মহাদেবী। সন্তোষী মাকে সন্তোষের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে অভিহিত করা হয়।[১] বিশেষত উত্তর ভারত ও নেপাল-এর মহিলারা সন্তোষী মায়ের পূজা করে। বার্ষিক ১৬টা শুক্রবার সন্তোষী মা ব্রত নামক এক ব্রত পালন করলে দেবী সন্তুষ্ট হন বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন।ষাটের দশকের শুরুতে সন্তোষী মায়ের প্রথম প্রচার হয়েছিল । মৌখিক কথা-কাহিনী, ব্রতের বিবরণী সংবলিত পুথি, পোষ্টার ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৭৫ সালে বলিউডের চলচ্চিত্র 'জয় সন্তোষী মা'-র মুক্তির পর পরই তাঁর জনপ্রিয়তা তুংগে ওঠে; অবশ্য যোধপুরে অনেক আগে থেকেই সন্তোষী দেবীর একটি মন্দির আছে।[২] চলচ্চিত্রটিতে তাঁকে গণেশ দেবতার কন্যা তথা মূল প্রকৃতির এক অংশাবতার হিসেবে দেখানো হয়েছিল। দেবীর জন্ম শুক্রবারে পূর্ণিমা তিথিতে হয়, সেহেতু সন্তোষী মার পূজার জন্য শুক্রবার দিনটি শ্রেষ্ঠ। ইনি চর্তুভূজা তথা রক্তবস্ত্র পরিহিতা, নিজের চারটি হাতের দুটিতে ত্রিশূল ও তলোয়ার ধারণ করেন ও বাকী দুটি হাতে বরাভয় ও সংহার মুদ্রা ধারণ করেন। এনার ত্রিশূলপাত তিনটি গুণের (সত্ত্ব,রজ,তম) প্রতীক ও তলোয়ারটি জ্ঞানের প্রতীক। হিন্দুধর্মগ্রন্থএ সন্তোষী মায়ের কোনো আখ্যানের উল্লেখ নেই যদিও দেবী ভাগবতে পার্বতীর জন্ম শুক্রবারে পূর্ণিমা তিথিতে হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। এর সাথে পার্বতী দেবীর সেই স্বরূপকে চতুর্ভূজা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে যা হিমালয়কে দেবীগীতের মাধ্যমে সন্তোষ প্রদান করেছিল। বৈষ্ণব আদর্শে ভগবতী যোগমায়াকেই বিভিন্ন দেবীর রূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে উপাসনা করা হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

পূজা পদ্ধতি সম্পাদনা মা সন্তোষীর পূজাতে টক বস্তু, আমিষ দ্রব্য প্রদান নিষেধ । সাধারণত আমিষ দ্রব্যকে তমঃ গুন সম্পন্ন আহার বলা হয় । টক পদার্থ হল রজগুনী আহার । মিষ্ট দ্রব্য হল সত্ত্ব গুনী আহার । মায়ের ভক্তদের ঐ তম, রজ গুনের ওপরে সত্ত্ব গুনে অধিষ্ঠিত হতে হয় । তাই ভক্ত গন মাকে কেবল মিষ্ট দ্রব্য ভোগে অর্পণ করেন। মায়ের প্রসাদ গো জাতীয় প্রানীকে অল্প প্রদান করার নিয়ম। কারণ গো মাতা হিন্দু দিগের আরাধ্য। গো জাতিকে রক্ষা ও ভরন পোষণের জন্য এই নিয়ম । প্রতি শুক্রবারে মায়ের ব্রত করার নিয়ম। মায়ের পূজোতে সরিষার তৈল নিষেধ। ঘিয়ের প্রদীপ দিতে হয়। সরষের তেল রজ গুনী। তাই একাদশী তিথিতে সরিষার তৈল বর্জনীয় । শুক্রবারে স্নান সেড়ে শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের পূজো করতে হবে। তিথি নক্ষত্র দোষ নেই এই পূজাতে। সাধারণত উদ্‌যাপন ছাড়া এই পূজোতে পুরোহিত লাগে না। সবাই করতে পারবেন । খেয়াল রাখবেন এই দিন গৃহে কোন সদস্য বা যিনি ব্রত পূজা করবেন- ভুলেও যেনো টক পদার্থ না গ্রহণ করেন। অনান্য সদস্য গন হোটেলে বা রেষ্টুডেন্ট, বিয়ে , অন্নপ্রাশনে খাবেন না। ঘট স্থাপন করবেন বট, কাঠাল, পাকুড় পল্লব দ্বারা। আম পল্লব দেবেন না । পূজোতে সব পুষ্পই চলবে। বিল্বপত্র আবশ্যক । ঘটে পুত্তলিকা অঙ্কন করবেন সিঁদুরে ঘি মিশিয়ে। ঘি প্রদীপ পূজাতে ব্যবহার করবেন । ঘটে গোটা ফল হিসাবে কলা দেবেন । এরপর আচমন , বিষ্ণু স্মরণ, আসন শুদ্ধি, সূর্য অর্ঘ, সঙ্কল্প করে গুরুদেব ও পঞ্চ দেবতার পূজা করে মায়ের পূজা করবেন । ধ্যান মন্ত্র প্রনাম মন্ত্র বলবেন । মনের প্রার্থনা মায়ের চরণে জানাবেন। পূজা শেষে মায়ের প্রসাদ গোমাতা কে অল্প দিয়ে নিজে গ্রহণ করবেন । এই ভাবে ১৬ শুক্রবার ব্রত করবেন । ভোগে দেবেন ভেজানো ছোলা ও আঁখের গুড়। ইচ্ছা হলে মিষ্ট ফল নিবেদন করতে পারেন । শুক্রবার যিনি ব্রত করবেন সারা দিন উপবাস থাকবেন । দুধ, ছোলা ঘিতে আলু সহিত ভেজে, মিষ্ট ফল, জল গ্রহণ করবেন । অসমর্থ হলে একবেলা উপবাস রেখে অপর বেলা আলু সেদ্ধ, ঘি, আতপ অন্ন গ্রহণ করতে পারেন । ১৬ শুক্রবার ব্রত হলে উদ্‌যাপন করবেন । উদ্‌যাপনের দিন ৭ টি বালককে ভোজোন করাবেন । খেয়াল রাখবেন সাত বালক যেনো সেই দিন টক বস্তু না খায় । উদ্‌যাপনের দিন ১৬ টি নিমকী চিনির রসে ডুবিয়ে মায়ের কাছে উৎসর্গ করবেন। ছানা থেকে তৈরী কোন মিষ্টি মাকে দেবেন না। উদ্‌যাপনের দিন মায়ের কাছে একটি নারকেল ফাটিয়ে নারকেলের জল মায়ের চরণে দেবেন । নারকেল মায়ের সামনে ফাটাবেন এক আঘাতে। ফাটানোর সময় মায়ের নামে জয়ধ্বনি দেবেন । এই ভাবে মা সন্তোষীর ব্রত করুন। দেখবেন মায়ের কৃপায় আপনার জীবন সুখে শান্তিতে ভরে যাবে । মায়ের কৃপায় সব অমঙ্গল, দুঃখ, অশান্তি নষ্ট হবে ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সেন, অনিরুদ্ধ। "বরাক উপ্যতকার বঙ্গীয় সমাজের লৌকিক দেবতা ও ব্রত পার্বণ"। করিমগঞ্জ কলেজ পত্রিকা ২০১৩-২০১৪ (করিমগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদ মুখপত্র), ২৩-২৯, ২০১৪।