সংহিতা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ঈশ্বরের তিনটি শক্তির প্রকাশ- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর পদ্মফুলে বসে আছেন যথাক্রমে সরস্বতী, লক্ষী ও পার্বতীর সাথে।

সংহিতা (সংস্কৃত: संहिता, saṁhitā) (আক্ষরিক অর্থে, “একত্রিত, মিলিত, যুক্ত” এবং “নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে একত্রিত গ্রন্থ বা মন্ত্র-সংকলন)[১][২] হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ বেদের প্রাচীনতম অংশটিকেও ‘সংহিতা’ বলা হয়। এই অংশটি হল মন্ত্র, স্তোত্র, প্রার্থনা, প্রার্থনা-সংগীত ও আশীর্বচনের সংকলন।[৩]

বৈদিক সংহিতাগুলির কিছু অংশ হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম অংশ যা আজও প্রচলিত আছে।[৩]

নাম-ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

‘সংহিতা’ একটি সংস্কৃত শব্দ। এই শব্দের মূল ‘সং’ (सं) ও ‘হিত’ (हित) শব্দদুটি। এই শব্দদুটির অর্থ যথাক্রমে ‘সঠিক, যথার্থ’ ও ‘সমৃদ্ধ, বিন্যস্ত’। এই দুই শব্দের সম্মিলিত অর্থ হল ‘একত্রিত, মিলিত, রচনা, বিন্যাস, একত্রীকৃত’ এবং ‘উচ্চারণের নিয়ম অনুসারে যুক্ত অক্ষর, নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে সংকলিত গ্রন্থ বা মন্ত্রসমূহ’।[১]

বিবরণ[সম্পাদনা]

সাধারণভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে সংকলিত যে কোনো গ্রন্থ বা মন্ত্র-সংগ্রহকেই ‘সংহিতা’ বলা যায়। যে কোনো শাস্ত্র, সূত্র বা সংস্কৃত মহাকাব্য এবং সর্বোপরি বৈদিক সাহিত্য ‘সংহিতা’ পদবাচ্য।[১]

যদিও সমসাময়িক সাহিত্যে ‘সংহিতা’ বলতে বেদের আদি ও প্রাচীনতম অংশটিকেই বোঝায়। এই অংশে আক্ষরিক অর্থ সহ বা অর্থবোধ ছাড়া মন্ত্র, সাধারণ ভাষণ, প্রার্থনা, প্রার্থনা-সংগীত ও আশীর্বচন সংকলিত রয়েছে। এগুলি প্রকৃতি বা বৈদিক দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত।[৩] বৈদিক সংহিতা বলতে বোঝায় গাণিতিক নিয়মে নিবদ্ধ ছন্দে রচিত প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। বেদের প্রতিটি ভাগেই (ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদঅথর্ববেদ) একটি করে সংহিতা রয়েছে।

প্রতিটি বেদ চার ভাগে বিভক্ত। যেমন, সংহিতা (মন্ত্র ও আশীর্বচন), আরণ্যক (রীতিনীতি, অনুষ্ঠান, যজ্ঞ ও প্রতীকী-যজ্ঞ সংক্রান্ত শাস্ত্র), ব্রাহ্মণ (রীতিনীতি, অনুষ্ঠান ও যজ্ঞ বিষয়ে ব্যাখ্যা) এবং উপনিষদ্‌ (ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনা শাস্ত্র)।[৪][৫][৬] সংহিতাকে বেদের ‘কর্মকাণ্ড’ (कर्म खण्ड, আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিভাগ) এবং উপনিষদ্‌গুলিকে ‘জ্ঞানকাণ্ড’ (ज्ञान खण्ड, জ্ঞান/আধ্যাত্মিকতা সংক্রান্ত বিভাগ) বলা হয়ে থাকে।[৪][৭] আরণ্যক ও ব্রাহ্মণগুলিকে কেউ কেউ কর্মকাণ্ড, আবার কেউ কেউ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

বৈদিক সংহিতাগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাঠ করা হত। এগুলিই হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম অংশ যা আজও প্রচলিত আছে।[৩]

বেদ ও পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় যে, বৈদিক সংহিতাগুলি সংক্ষিপ্তসার এবং তৎ-সম্পর্কিত বৈদিক গ্রন্থগুলি এখন যে আকারে পাওয়া যায়, প্রকৃতপক্ষে তার থেকে এগুলির আকার অনেক বড়ো ছিল। ভারতীয় ইতিহাসের কোনো এক সময়ে বা কোনো এক পর্যায়ে এগুলির কিয়দংশ হারিয়ে গিয়েছে।[৮]

উদাহরণ[সম্পাদনা]

ঋগ্বেদ সংহিতা[সম্পাদনা]

গায়ত্রী মন্ত্র হিন্দুধর্মের একটি বিখ্যাত মন্ত্র। এটি ঋগ্বেদ সংহিতায় পাওয়া যায়।[৯]

ॐ भूर्भुवस्व: | तत्सवितुर्वरेण्यम् | भर्गो देवस्य धीमहि | धियो यो न: प्रचोदयात्
ওঁ ভুর্ভূবস্বঃ। তৎসবিতুর্বরেণ্যম্‌। ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ
দিব্য আলোকের (সূর্য) মহৎ গৌরব ধ্যান তিনি আমাদের চিন্তালোককে উদ্বুদ্ধ করুন, আমার চৈতন্য জাগরিত করুন।
ঋগ্বেদ ৩। ৬২। ১০[৯][১০]

সামবেদ[সম্পাদনা]

ওয়েবার বলেছেন, যে সামবেদ সংহিতা প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদ সংহিতা থেকে গৃহীত মন্ত্র-সংকলন।[১১] উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হল সাংগীতিক সুর ও ছন্দ এবং ভাষাগত পরিমার্জনা ও প্রয়োগভঙ্গিমা।[১২] এইভাবে মূল মন্ত্রটি পরে ‘রথান্তর’ (সুন্দর রথ) মন্তত্রে পরিণত হয়েছে। সামবেদ ও ঋগ্বেদ সংহিতায় প্রাপ্ত এই ধরনের একটি মন্ত্রের উদাহরণ হল,[১২]

ঋগ্বৈদিক রূপ: অভি ত্ব সুরা নোনুমো দুগ্বা ইব ধেনবঃ। ঈশানাং অস্য জগতঃ স্বর্দর্শং ঈশানাং ইন্দ্র তস্থুশঃ
সামবৈদিক রূপ: ওভিত্বসুরানোনুমোবা। অদুগ্ধ ইব ধেনব ঈশানামস্য জগতসসুবর্দশম। ঈশানাং ইন্দ্র। ই স্থু ও ব হ উ ব। অস।।
অনুবাদ (উভয় মন্ত্রের):[১২]
হে বীর, যে গাভীর দুগ্ধ দোহন করা হয়েনি, সে যেমন জগদীশ্বরকে আহ্বান করে, আমরা তেমনই আপনাকে আহ্বান করি!
হে ইন্দ্র! জড় বিশ্বের ঈশ্বর আপনি। আপনার চক্ষু হলেন সূর্য!

যজুর্বেদ[সম্পাদনা]

যজুর্বেদ সংহিতার ৪। ১। ৫।–সংখ্যক স্তোত্রটি একাধিক প্রাচীন দেবদেবীর প্রতি উৎসর্গিত। এটি হল:[১৩][১৪]

বসুগণ গায়ত্রী ছন্দ দ্বারা আপনাকে প্রস্তুত করুন; আপনি পৃথিবী,
রুদ্র ত্রিষ্টুপ ছন্দ দ্বারা আপনাকে প্রস্তুত করুন; আপনি আকাশ।
আদিত্যগণ জগতী ছন্দ দ্বারা আপনাকে প্রস্তুত করুন; আপনি স্বর্গ।
বিশ্বদেবগণ, যাঁরা সকল মানবলোকের, তাঁরা আপনাকে অনুষ্টুপ ছন্দ দ্বারা প্রস্তুত করুন; আপনি সর্বদিকময়।
আপনি অপরিবর্তনীয় দিক, আমাকে সন্তান দান করুন, প্রচুর অর্থসম্পদ দিন, প্রচুর গোসম্পদ দিন, অতুল শৌর্য প্রদান করুন।

— তৈত্তিরীয় সংহিতা, ৪। ১। ৫[১৩]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. saMhita, Monier-Williams' Sanskrit-English Dictionary, Cologne Digital Sanskrit Lexicon, Germany
  2. samhita[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] Sanskrit-English Dictionary, Koeln University, Germany
  3. Lochtefeld, James G. "Samhita" in The Illustrated Encyclopedia of Hinduism, Vol. 2: N-Z, Rosen Publishing, আইএসবিএন ০-৮২৩৯-২২৮৭-১, page 587
  4. A Bhattacharya (2006), Hindu Dharma: Introduction to Scriptures and Theology, আইএসবিএন ৯৭৮-০৫৯৫৩৮৪৫৫৬, pages 8-14
  5. Jan Gonda (1975), Vedic Literature: (Saṃhitās and Brāhmaṇas), Otto Harrassowitz Verlag, আইএসবিএন ৯৭৮-৩৪৪৭০১৬০৩২
  6. Gavin Flood (1996), An Introduction to Hinduism, Cambridge University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০৫২১৪৩৮৭৮০, pages 35-37
  7. See গুগল বইয়ে Shankara's Introduction to Brihad Aranyaka Upanishad at pages 1-5; Quote - "The Vedas are divided in two parts, the first is the karma-kanda, the ceremonial part, also (called) purva-kanda, and treats on ceremonies; the second part is the jnana kanda, the part which contains knowledge, also named uttara-kanda or posterior part, and unfolds the knowledge of Brahma or the universal soul." (Translator: Edward Roer)
  8. Stephen Knapp (2005), The Heart of Hinduism: The Eastern Path to Freedom, Empowerment and Illumination, আইএসবিএন ৯৭৮-০৫৯৫৩৫০৭৫৯, pages 9-16
  9. Monier Monier-Williams (1893), Indian Wisdom, Luzac & Co., London, page 17
  10. Edward F Crangle (1994), The Origin and Development of Early Indian Contemplative Practices, Otto Harrassowitz Verlag, আইএসবিএন ৯৭৮-৩৪৪৭০৩৪৭৯১, page 124
  11. Albrecht Weber, History of Indian Literature, গুগল বইয়ে Samaveda-Samhita, page 63
  12. Frits Staal (2009), Discovering the Vedas: Origins, Mantras, Rituals, Insights, Penguin, আইএসবিএন ৯৭৮-০১৪৩০৯৯৮৬৪, pages 107-115
  13. Harvey P. Alper (2012), Understanding Mantras, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১২০৮০৭৪৬৪, pages 75-76
  14. Edward F Crangle (1994), The Origin and Development of Early Indian Contemplative Practices, Otto Harrassowitz Verlag, আইএসবিএন ৯৭৮-৩৪৪৭০৩৪৭৯১, page 32

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]