শ্রীশৈল শক্তিপীঠ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

শ্রীশৈল বাংলাদেশের সিলেট (আদি শ্রীহট্ট) শহরের ৩ কি.মি. উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ সুরমা (সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে) জৈনপুর গ্রামে অবস্থিত একটি শক্তিপীঠ[১] এখানে সতী দেবীর গ্রীবা (গন্ডদেশের পেছন দিক) পতিত হয়েছিল। ফলে উক্ত স্থানটি “গ্রীবামহাপীঠ” নামে পরিচিতি লাভ করে। দেবী এখানে মহালক্ষ্মী হিসেবে পূজিত হন এবং অনতিদূরে ঈশান কোণে গোটাটিকর গ্রামে “সর্বানন্দ ভৈরব” নামে পীঠরক্ষী শিব মন্দির অবস্থিত [২]

হিন্দু ভক্তদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

তন্ত্র মতে --

গ্রীবা পপাত শ্রীহট্টে সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী ।

দেবীতত্র মহালক্ষ্মী সর্বনন্দশ্চ ভৈরব ।।

আইকনোগ্রাফি[সম্পাদনা]

দেবী মহালক্ষ্মী হলেন চণ্ডীর বৈকৃতিক রহস্যে বর্ণিত অষ্টাদশ ভুজা সৈরিভমর্দিনী।

শক্তিপীঠ আবিষ্কৃত হওয়ার ইতিহাস[সম্পাদনা]

কথিত এই যে, দেবীর গ্রীবার পতন হয়েছিল একটি শিলার ওপর, এই শিলাই পূজিতা হতেন আদিকাল থেকে। এই পীঠ বহুকাল গুপ্ত ছিল। বাংলার দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মাঝে এখানে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছিল। সে সময় দেবীপ্রসাদ দাশ নামক এক ব্যক্তি রাস্তার কাজের জন্য কিছু শ্রমিককে নিযুক্ত করেন। রাস্তা মেরামতের সময় মাটি খুড়লে একটি কালো শিলা বের হয়ে আসে। কিছুতেই সেই শিলাকে সড়ানো যাচ্ছিলো না। এক শ্রমিক শাবল দিয়ে শিলাকে দুখণ্ড করে দিলো এবং সাথে সাথে পাশের জঙ্গল থেকে একটি বালিকা বের হয়ে সেই শ্রমিক কে চড় মারলো এবং সকলকে হতবাক করে নিমিষে সেই বালিকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সেই রাত্রে দেবীপ্রসাদকে মা মহালক্ষ্মী স্বপ্নাদেশ দিয়ে বললেন --

তুই এই স্থানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজোর ব্যবস্থা কর।

ধনী দেবীপ্রসাদ লক্ষ ইট দিয়ে দেবীর মন্দির তৈরির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু পরদিন রাতেই আবার স্বপ্নাদেশ পেলেন --

আমি বদ্ধ থাকতে চাইনা, আমার মন্দির নির্মাণের প্রয়োজন নেই, আমাকে তুই উন্মুক্ত অবস্থায় রাখিস, আমি উন্মুক্ত অবস্থাতেই পূজিত হতে চাই।

দেবীর আদেশাক্রমে দেবীপ্রসাদ শিলার চারপাশে ইঁট দিয়ে চারপাশে মুরে দিলেন। আজোও দেবীপ্রসাদের বংশধরেরা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিযুক্ত আছেন।

ভৈরব আবিষ্কৃত হওয়ার ইতিহাস[সম্পাদনা]

দেবীর মতোই ভৈরব সর্বানন্দ প্রথমে অজ্ঞাত ছিলেন। একদিন এক মহান সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরি শ্রীহট্টে আসলেন এবং দেবীর সাধনাতে সিদ্ধ হয়েছিলেন। সেই সাধক সাধনাবলে জানতে পারলেন, দেবী মহালক্ষ্মীর পশ্চিমদিকে রয়েছে একটি টিলা এবং সেই টিলার মধ্যেই ভগবান শিব আছেন। একদিন গভীর রাতে সেই সাধক তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সেই টিলায় উঠে জানালেন,

এই স্থানেই দেবীর ভৈরব আছেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১২৮১ বঙ্গাব্দে সেই ভৈরব উদ্ধার করার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন। আচার্য শঙ্করের দশনামী সম্প্রদায়ের সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরির এক শিষ্য ছিল, তিনিও বড় সাধক ছিলেন। তাঁর নাম ছিলো বিরজানাথ ন্যায়বাগীশ, ১২৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে তিনি দেখলেন তাঁর গুরুদেব ব্রহ্মানন্দ গিরি দুজন শিষ্যকে নিয়ে সেই শিবটিলায় উঠে বলছেন --

এখানে দেবীর ভৈরব আছেন, আমি তাঁকে প্রকাশ করবো।

মাটি খুঁড়ে শিবলিঙ্গটি দেখতে পেলেন। স্বপ্নভঙ্গহতেই বিরজানাথ দেখতে পেলেন তাঁর দুজন শিষ্য কৈলাসচন্দ্র ভট্টাচার্য ও কৃষ্ণকুমার ভট্টাচার্য বাড়ীতে এসেছেন। অলৌকিকভাবে তাঁরা দুইজনেও একই স্বপ্ন দেখেছেন এবং দুই শিষ্যই গুরুদেবকে স্বপ্নটি বৃতান্ত বললেন। গুরুদেব বিরজানাথ যখন বুঝলেন তারা তিনজনই একই রাত্রে একই স্বপ্ন দেখেছেন, তখন কালবিলম্ব না করেই গুরুদেব বিরজানাথ দুই শিষ্য সমেত সেই টিলায় উঠে মাটি খনন করতেই গৌরীপট্টসহিত শিবলিঙ্গ উঠে আসলো। এভাবে দেবীর ভৈরব প্রকট হলেন । গ্রামের লোক সব ছুটে আসলো এবং এইভাবেই শুরু হলো শিব আরাধনা। [২]

আবার আরেক মতে  সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস সিলেটের কালাগুল চা বাগানে মহাদেব শিবপত্নী মা কালি বা সতীর গ্রীবাংশটি পড়েছিল। কালিবাড়ী মন্দিরে পাথর রূপে তা সংরক্ষিত। তা দেখতে প্রতিদিন নানা ধর্মের মানুষ মন্দিরটিতে ভিড় করে। তা ছাড়া মন্দিরের ভেতর যে কুণ্ডে তা সংরক্ষিত, তার পানি পান করে অসুস্থ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই উপকৃত হন বলেও ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। প্রতি বছর ৯ ফাল্গুন বাৎসরিক পূজা মহোৎসবের আয়োজন করা হয় এখানে। তখন কালাগুল তো বটে, সিলেট অঞ্চলজুড়ে এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।

গুরুত্ব[সম্পাদনা]

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখন্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।[৩]

মানচিত্র

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]