কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের জলবায়ু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের প্লাবন তৃণভূমি

কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান (Assamese: কাজিৰঙা ৰাষ্ট্ৰীয় উদ্যান, Kazirônga Rastriyô Uddyan) ভারতের আসাম রাজ্যে নগাঁওগোলাঘাট জেলায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত জাতীয় উদ্যানএশীয় একশৃঙ্গ গণ্ডারের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল কাজিরাঙ্গা ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি।[১] ১৯০৫ সালে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের অন্যসব সংরক্ষিত অঞ্চলের তুলনায় কাজিরঙ্গাতে বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ২০০৬ সালে কাজিরঙ্গাকে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্যান এশীয় হাতি, বুনো মহিষবারশিঙ্গার এক বৃহৎ প্রজনন ক্ষেত্র।[২] অসংখ্য পাখি প্রজাতির অনন্য সমাবেশস্থল বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল কাজিরাঙ্গাকে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষীক্ষেত্র (Important Bird Area) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কাজিরাঙ্গা লম্বা শন (Miscanthus sinensis), জলাভূমি ও ঘন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও অর্ধ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশস্তপত্রী বৃক্ষের অরণ্যে পরিপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্র নদ, ডিফলু নদী, মরা ডিফলু নদীমরা ধানসিঁড়ি নদী, এই চারটি প্রধান নদী এর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। পুরো উদ্যানে অসংখ্য ছোট-বড় বিল রয়েছে। ২০০৫ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়।

প্রধান ঋতু[সম্পাদনা]

কাজিরাঙ্গায় নিয়ন্ত্রিত অগ্নিসংযোগ

কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানে ঋতু প্রধানত তিনটি: গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল। শীতকাল শুষ্ক এবং তীব্র নয়। এ সময় সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ২৫° সে. থেকে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৫° সে. পর্যন্ত হয়। অধিকাংশ বিল ও খালগুলো শীতকাল এলে শুকিয়ে যায়।[৩] মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭° সে. পর্যন্ত হয়। এ সময় প্রচণ্ড গরম থাকে আর পশুপাখিরা জলাশয়ের আশেপাশে থাকে। শুষ্ক মৌসুমগুলোতে বন্যপ্রাণীদের খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। জুন থেকে বর্ষাকাল শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই দীর্ঘ বর্ষাকাল কাজিরাঙ্গার বার্ষিক ২,২২০ মিলিমিটার (৮৭ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাতের জন্য অনেকাংশে দায়ী। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে আগত মৌসুমী বায়ু বর্ষাকালের প্রধান কারণ। জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং উদ্যানের পশ্চিম ভাগের দুই তৃতীয়াংশ তলিয়ে যায়। এসময় বন্যপ্রাণীরা উদ্যানের দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচু ভূমিতে আশ্রয় নেয়। মিকির পর্বতমালা এদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। ২০১২ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় উদ্যানের প্রায় ৫৪০টি বন্যপ্রাণী ভেসে যায়; এদের মধ্যে ১৩টি গণ্ডার আর বেশিরভাগই প্যারা হরিণ[৪] [৫]

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাঝামাঝি অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম বৃষ্টিবহুল এলাকা। প্রতিবছর উদ্যানটি ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে প্লাবিত হয়। উদ্যানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এ বন্যার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এমনও দেখা গেছে যে, পাঁচ থেকে দশ দিন পর পরই উদ্যানটি বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। কাজিরাঙ্গার পশ্চিমাংশের তিন-চতুর্থাংশ (বাগুরি এলাকা) প্রায় প্রতিবছরই বন্যার পানিতে ডুবে যায়।[৫]

ঋতুবৈচিত্র্য[সম্পাদনা]

ঋতুপরিবর্তনের ফলে কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল আর পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষত শীতকালে এর বেশিরভাগ বিলনালাগুলো শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে যাওয়া অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছোট ঘাসের চাদরের সৃষ্টি হয়। বর্ষার শেষে এসব অঞ্চলগুলো তৃণভোজী প্রাণীদের চারণক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[৩]

পোড়া এলাকায় খাদ্যের খোঁজে হস্তীশাবক

উদ্যানের অন্যসব অঞ্চলের লম্বা ঘন ঘাসগুলো ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে শুকিয়ে যায়। দাবানলের ভয়ে উদ্যানের কর্মচারীরা সেসব এলাকার ঘাস নিয়ন্ত্রিতভাবে পুড়িয়ে দেয়। পোড়ানোর পর কিছু কিছু পশু পোড়া অঞ্চলে চলে যায় উষ্ণতা ও পোড়া মূল খাওয়ার লোভে। শীতের শেষের দিকে বৃষ্টিপাত হয় ও পোড়া জায়গায় পুনরায় কচি ঘাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন সেসব এলাকায় তৃণভোজী প্রাণীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।[৩]

তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে উদ্যানের ঘাসগুলো বেড়ে ওঠে। মূলগুলো শক্ত হয়ে পড়ে এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। ফলে পশুপাখি সেসব অঞ্চলে বিরল হয়ে যায়। গ্রীষ্মের দাবদাহে পশুরা ক্লান্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন ছোট-বড় জলাশয়ের আশেপাশে তখন বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি নজরে পড়ে। বর্ষাকালে শুষ্ক জলাশয়গুলো আবার ভরে ওঠে। প্রথমে বর্ষার বৃষ্টিপাতে, এবং পরবর্তীতে বন্যার পানিতে কাজিরাঙ্গার এসব জলাশয় পূর্ণ হয়। পানি বাড়ার সাথে সাথে পশুপাখিরা আশ্রয়ের খোঁজে তৃণভূমি ছেড়ে গাছপালা সম্বৃদ্ধ উঁচু এলাকায় সরে যায়। পুরো উদ্যান পানিতে ডুবে গেলে বেশিরভাগ পশুপাখি পার্শ্ববর্তী কার্বি আঙলং পাহাড়শ্রেণী ও অন্যান্য উঁচু এলাকায় সরে যায়।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Bhaumik, Subir (১৭ এপ্রিল ২০০৭)। "Assam rhino poaching 'spirals'"BBC News। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩ 
  2. "Welcome to Kaziranga"। ৩০ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০১২ 
  3. :pp. ২০–২১Mathur, V.B.। "UNESCO EoH Project_South Asia Technical Report–Kaziranga National Park" (পিডিএফ)। UNESCO। ২০০৮-০৫-৩০ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  4. "Assam flood: Over 500 animals dead in Kaziranga"। ৭ জুলাই ২০১২। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০১২ 
  5. "UN Kaziranga Factsheet"UNESCO। ২০০৮-০৭-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩