নানকার বিদ্রোহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

নানকার বিদ্রোহ সিলেট অঞ্চলের একটি কৃষক-আন্দোলন, যা ১৮ আগস্ট ১৯৪৯ সালে সংগঠিত হয়।[১] জমিদারের ভূমিদাসদের একটি প্রথাকে "নানকার প্রথা" বলা হতো। বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত করার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।[২]

শব্দের উৎপত্তি[সম্পাদনা]

'নান' ফার্সি শব্দ, এর অর্থ রুটি এবং 'কার' অর্থ যোগান বা কাজ করা; অর্থাৎ 'নানকার' শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয় সেসব কর্মীদের যারা খাবারের বিনিময়ে কায়িক শ্রম দান করে।

নানকার কারা[সম্পাদনা]

কেবল খাবারের বিনিময়ে যে জমির ভোগস্বত্ব প্রজাদেরকে দেওয়া হতো সে জমিকেই নানকার জমি বলা হতো। এই নানকার প্রজারা ছিলো ভূমির মালিকের হুকুমদাস; প্রজাই নয় তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও বংশানুক্রমে ভূমি মালিকের দাস হতো। সাধারণতঃ নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই; যেমন: কিরান, নম-শূদ্র, মালি, ঢুলি, নাপিত, পাটনি প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরাই নানকার শ্রণীর প্রজা ছিল।[৩]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

নানকার একটি বর্বর শ্রম শোষণের প্রথা, অনেকটা মধ্যযুগীয় দাস প্রথার সঙ্গে তুলনীয়। প্রধানত সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ অঞ্চলে এই সামন্ত প্রথাটি প্রচলিত ছিল।[৪] সামন্ত ভূ-মালিকদের সিলেট অঞ্চলে মিরাশদার এবং বড় মিরাশদারকে জমিদার বলা হতো। জমিদার বা মিরাশদারবাড়ির নিকটবর্তী স্থানে কিছু প্রজার বসবাসের ব্যবস্থা করা হতো, তারাই ছিলেন নানকার প্রজা। জমিদারবাড়ির সার্বক্ষণিক গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকতে হতো তাদের। এমনকি গভীর রাতেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে জমিদারবাড়ির ডাকে ত্বরিত সাড়া না দিলে নেমে আসত অসহনীয় নির্যাতন।[৪]

ব্রিটিশ আমলে সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শোষণ পদ্ধতি ছিল নানকার প্রথা। নানকার প্রজারা জমিদারের দেয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি ভোগ করতেন, কিন্তু ওই জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না। তারা বিনা মজুরিতে জমিদার বাড়িতে বেগার খাটতো। চুন থেকে পান খসলেই তাদের উপর চলতো অমানুষিক নির্যাতন। নানকার আন্দোলনের সংগঠক কমরেড অজয় ভট্টচার্যের দেয়া তথ্যমতে, সে সময় বৃহত্তর সিলেটের ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার এবং নানকার প্রথা মূলত বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট জেলায় চালু ছিল। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা থানায় নানকার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সুতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার উপজেলা। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের নানকার কৃষকরা সর্বপ্রথম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

লাউতা বাহাদুরপুর অঞ্চলের জমিদাররা ছিল অতিমাত্রায় অত্যাচারী। তাদের অত্যাচারে নানকার, কৃষক সবাই ছিল অতিষ্ঠ। লোক মুখে শোনা যায়, বাহাদুরপূর জমিদার বাড়ির সামনে রাস্থায় সেন্ডেল বা জুতা পায়ে হাঁটা যেত না। ছাতা টাঙ্গিয়ে চলা ও ঘোড়ায় চড়াও ছিল অপরাধমূলক কাজ। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করতো তবে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো।[১] জমিদারদের এহেন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও তার শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস কারোরই ছিল না। শোনা যায় নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেও কেউ জমিদারদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেত না। দিনে দিনে জমিদারদের অত্যাচার বাড়ত থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে মানুষের মনের ক্ষোভ, এই অনাচারের প্রতিকার চায় সবাই। তাই গোপনে গোপনে চলে শলাপরামর্শ। কেউ কেউ আবার সাহস সঞ্চার করে এ সময় নানকার ও কৃষকদের সংগঠিত করতে কষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় হয়।[১]

কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চলতে থাকে নানকার কৃষকসহ সকল নির্যাতিত জনগনকে সংগঠিত করার কাজ। ১৯৪৭-এর আগেই অজয় ভট্টাচার্য আত্মনিয়োগ করেন নানকার প্রজাদের সংগঠিত করতে এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তা আইনে। দেশ বিভক্তির আগে ও পরে দুই ভাগে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ, যার অন্যতম রূপকার হলেন কমরেড অজয় ভট্টাচার্য[৪] নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করতে সে সময় অজয় ভিট্টাচার্যের সাথে কাজ করেছেন শিশির ভট্টাচার্য (লাউতা), ললিতপাল (লাউতা), জোয়াদ উল্ল্যা (নন্দিরপল), আব্দুস সোবহান (দক্ষিণ পট্টি) ও শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্য (লাউতা) সহ আরও কয়েকজন।[১] তাদের নেতৃত্বে নানকার কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে জমিদারের বিরুদ্ধে। বন্ধ হয়ে যায় খাজনা দেওয়া এমনকি জমিদারদের হাট-বাজারের কেনাকাটা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় জমিদার ও তার লোকজানকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ভীত সন্ত্রস্থ জমিদাররা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শরণাপন্ন হয়ে এ অঞ্চলের নানকার কৃষকদেরকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করে। জমিদারদের প্ররোচনায় পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়।

১৭ আগস্ট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্রাবণী সংক্রান্তি। প্রথম দিনের উৎসব আরাধনা শেষে আগামী দিন মনসা পূজার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে গভীর রাতে বিছানার গা এলিয়েছেন সানেশ্বর উলুউরির মানুষ। ভোরে উঠে পূজা আর্চনা, আনন্দ উৎসব আরও কত কি ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে সবাই। কিন্তু ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথে পেটোয়া বাহিনী আক্রমণ করে সানেশ্বরে। ঘুমন্ত মানুষ ভীতসন্তস্ত্র হয়ে ঘুম ভেঙ্গে দিগবিদিক পালাতে তাকে। সানেশ্বর গ্রামের লোকজন পালিয়ে পার্শ্ববর্তী উলুউরিতে আশ্রয় নেয়। উলুউরি গ্রামে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন নানকার আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও সুরথ পাল।[১]

তাদের নেতৃত্বে উলুউরিও সানেশ্বর গ্রামের কৃষক, নারী-পুরুষ সরকারী বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াবার প্রস্তুতি নেয় এবং লাটিসোটা, হুজা, ঝাটা ইত্যাতি নিয়ে মরণ ভয় তুচ্ছ করে সানেশ্বর ও উলুউরি গ্রামের মধ্যবর্ত্তী সুনাই নদীর তীরে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয় সরকারি ও জমিদার বাহিনীর সাথে। কিন্তু ইপিআরের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে লাটিসোটা নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি কৃষকরা। ঘটনা স্থলেই ঝরেন পড়ে ৬টি তাজা প্রাণ।

অজয় ভট্টাচার্য সিলেটের ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নানকার বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র ছিল লাউতা বাহাদুরপুর। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত লাউতা বাহাদুরপুর কেন্দ্রিক পঁয়তাল্লিশ সদস্য বিশিষ্ট নানকার আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা কমিটির সম্পাদক ছিলেন তিনি।[৫]

নানকার দিবস[সম্পাদনা]

১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট নানকারদের উপর পাকিস্তানি মুসলিমলীগ সরকারের ইপিআর, পুলিশ এবং জমিদারদের লাঠিয়াল বাহীনি সংঘবদ্ধ হয়ে সশ্রস্ত্র হামলা চালালে ৬ জন নানকার নিহত হন; তারা হলেন:

  • রজনী দাস (৫০) - ১৫ দিন আগে নিহত নদীর তীরে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে নিহত;
  • ব্রজনাথ দাস (৫০);
  • কুটুমনি দাস (৪৭);
  • প্রসন্ন কুমার দাস (৫০);
  • পবিত্র কুমার দাস (৪৫) ও
  • অমূল্য কুমার দাস (১৭) - পরবর্তী সময়ে বন্দী অবস্থান নিহত।

এসময় পুলিশের অত্যাচারে নানকার নেত্রী অন্তঃসত্ত্বা অপর্না পালচৌধুরীর গর্ভপাত ঘটে ঘটনাস্থলে।[৬] বীভৎস অত্যাচারে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। শ্রীহট্ট, রাজশাহীঢাকা জেলে তিনি ৫ বছর বন্দী থাকেন[৭][৭]

প্রথার সমাপ্তি[সম্পাদনা]

১৮ আগস্ট, ১৯৪৯ সালে মানব সভ্যতার ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল এক নির্মম ইতিহাস। ১৯৩৭ সালের ঘৃণ্য নানকার প্রথা রদ ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ওইদিন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের সুনাই নদীর তীরে পাকিস্তান ইপিআরের ছোড়া গুলিতে প্রাণ দেন পাঁচজন কৃষক।[১] এর প্রায় ১৫ দিন আগে সানেশ্বরে সুনাই নদীর বুকে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাতে শহিদ হন রজনী দাস। এ নিয়ে নানকার আন্দোলনে মোট শহিদের সংখ্যা হয় ছয়জন। আহত হোন হৃদয় রঞ্জন দাস, দীননাথ দাস, অদ্বৈত চরণ দাসসহ অনেকে। বন্দি হোন এই আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও উলুউরি গ্রামের প্রকাশ চন্দ্র দাস, হিরণ বালা দাস, প্রিয়মণি দাস, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও মনা চন্দ্র দাস। এ ঘটনার পরেই আন্দোলনে উত্তাল হয় সারাদেশ।[১] তাদের এই আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।[১][২] তাই বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে, বিশেষ করে অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল গৌরবান্বিত আন্দোলন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষক বিদ্রোহ বা নানকার আন্দোলন।

আন্দোলনের সাথে জড়িত কয়েকজন সংগঠক[সম্পাদনা]

নানকার বিদ্রোহের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সংগঠক হলেন:

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "নানকার বিদ্রোহ"। দৈনিক কালেরকণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০১৭ 
  2. "আমাদের নগরী"। দৈনিক এসসিসি। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০১৭ – সরকারি ওয়েবসাইট-এর মাধ্যমে। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. আজ নানকার কৃষক বিদ্রোহ দিবস[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রকাশিত হয়েছে ১৩ আগস্ট, ২০১১।
  4. "নানকার বিদ্রোহের বীর"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০১৭ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  5. "ভট্টাচার্য, কমরেড অজয়"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০১৭ 
  6. অনিন্দ্য আরিফ (১৪ নভেম্বর ২০১৪)। "বাংলার বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ"কালের কন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  7. দ্বিতীয় খন্ড, অঞ্জলি বসু সম্পাদিত (২০০৪)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ১৪। আইএসবিএন 81-86806-99-7 
  8. [১] নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ হেনা দাস- দৈনিক যায় যায় দিন

বহি:সংযোগ[সম্পাদনা]