ছয়ের উদ্দিন আহমেদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ছয়ের উদ্দিন আহমেদ
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্মরংপুর
নাগরিকত্ববাংলাদেশী
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পেশারাজনীতি
যে জন্য পরিচিতরাজনীতিবিদ,

ছয়ের উদ্দিন আহমেদ (এপ্রিল, ১৯২১ - ১৫ মার্চ ২০০৮ বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের একজন বাম ধারার রাজনীতিবিদসমাজ সংস্কারক। তিনি বৃহত্তর রংপুরের ভাষা আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জন্ম ও শৈশব[সম্পাদনা]

কমরেড ছয়ের আহমেদ ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত কৃষক পিতা কিনু মোহাম্মদ আর গর্ভধারিণী মা আছিরন বিবির প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। কমরেড ছয়ের উদ্দিনের ছোট ভাই দাশু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। ছোট বোন নুরজাহান আর পিতা-মাতাকে নিয়ে বাল্যকাল বেশ সুখের ছিল তার।

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

শৈশবে কুন্ডি পরগনার অধীন উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। মাইনর পাস করতে পেরেছিলেন। তার পিতা কিনু মোহাম্মদ মাত্র ৪৩ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে মাইনর অধ্যয়নরত অবস্থায় সংসারের দায়-দায়িত্ব চাল আসে তার কাঁধে। কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ তার শৈশবে খুব কাছ থেকে দেখেছেন নিরীহ প্রজাদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার। শ্রেণী-বৈষম্য তাকে বেশ মর্মাহত করেছিল। আর তাই তো শৈশবে তৎকালীন সমাজের সুইপারের সন্তানরাও তার বন্ধুর তালিকায় স্থান পেয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ শ্রেণীনির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশতেন তিনি। কৈশোরে পদার্পণ করে তিনি যখন বুঝলেন তার পিতা মহাজনী প্রথায় সুদের কারবার করেন। সুদের টাকা পরিশোধ করতে অসহায় কৃষকরা তার পিতার হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তখন তিনি হয়রানির শিকার কৃষকদের প নিয়ে পিতা কিনু মোহাম্মদের অনৈতিক সুদের ব্যবসার প্রতিবাদ করেন। সে প্রতিবাদের ফল হিসেবে তার পিতা সুদের ব্যবসা ছেড়ে দিলে তিনি অনুপ্রাণিত হন। সেই থেকেই তার মনে বিপ্লবী চেতনার বিকাশ। যার ইতিবাচক ফল প্রত্যন্ত পল্লীর কিশোর ছয়ের উদ্দিনকে আজকের অবস্থানে এনেছিল। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে সৎ মায়ের অত্যাচারের শিকার হন। পিতাকে হারান অল্প বয়সে। যে কারণে মোটেও সুখকর ছিল না তার শৈশব।

রাজনৈতিক জীবন[সম্পাদনা]

সংসারের টানাপোড়েন আর পারিপার্শ্বিকতার মাঝে বেড়ে ওঠা এ রাজনীতিবিদ ১৯৩৯ সালে যুক্ত হন ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তৎকালীন ব্রিটিশ শোষকদের অত্যাচার-জুলুমের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হবার প্রত্যয় নিয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকার তলে আশ্রয় খোঁজেন। তারপর শুরু হয় তরুণ ছয়ের উদ্দিনের আজকের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ হয়ে ওঠার গল্প।

তেভাগা আন্দোলন ও অন্যান্য কৃষক সংগ্রামে যোগদান[সম্পাদনা]

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর অঞ্চলে জমিদারেরা বিভিন্ন হাট থেকে অতিরিক্ত হারে তোলা আদায় করত। জমিদারদের অতিরিক্ত দোলা আদায়ের প্রতিবাদে গড়া ‘হাট তোলা বন্ধ আন্দোলন’-এ যোগ দেন কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ। এ আন্দোলনের ফলে জমিদারেরা এ অঞ্চলে অতিরিক্ত হারে হাট তোলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এরপর আসে ১৩৪৩ সালের কৃষকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন। এ আন্দোলন পরবর্তীকালে রূপ নেয় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে রংপুরে উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতাদের বৈঠক হয়। এরপর তৎকালীন দিনাজপুর জেলার আটোয়ারী থানার রামপুর গ্রাম থেকে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনের ছোঁয়া লাগে রংপুরের নীলফামারী মহকুমার ডোমার থানায়। প্রভাবশালী জোতদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে কৃষকের অধিকার আদায়ের এ সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছিলেন কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ। তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৭ সালে স্তিমিত হওয়ার পর মহান এ নেতা রংপুর অঞ্চলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আজীবন কৃষি ও কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক বিকাশের স্বপ্নস্রষ্টা কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। গণমানুষের আন্দোলনের কারণে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ৮ দফায় ১৪ বছর বিনা কারণে রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে আটক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান[সম্পাদনা]

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নিষিদ্ধ ঘোষণা, শাষকদের অত্যাচার, কারাভোগের পরও দমেননি তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি কমরেড জিতেন দত্ত, কমরেড মণি কৃষ্ণ সেন, রংপুরের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামছুজ্জামান এবং আলহাজ মজিবর রহমান মাস্টারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্যমী তরুণ যুবকদের উৎসাহিত করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের সংগঠিত করে ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানোর পাশাপাশি নানা তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। তিনি ২৮ মার্চ ১৯৭১, ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচীর অন্যতম সংগঠক।[১]। আজীবন দেশ, মাটি ও মানুষের কল্যাণে ব্রতী কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ আন্দোলনে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ কৃষক সমিতি এবং বাংলাদেশ আখচাষী সমিতির সভাপতি ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।

চেয়ারম্যান নির্বাচিত[সম্পাদনা]

স্বাধীনতার পর রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার ১১ নঙ্গি গোপালপুর উইনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।[২]। ১৯৯৭ সালে তেভাগা আন্দোলনের জন্য ভারতের কলকাতায় আরও দুজন বীর বাঙালি প্রথিতযশা সাংবাদিক নির্মল সেন ও ঠাকুরগাঁওয়ের প্রয়াত প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ মেরাজুল হোসেনের সঙ্গে তিনিও সংবর্ধিত হন। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ছিল তার এ সংবর্ধনা। কিন্তু যে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্য কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ লড়াই করেছেন, সে দেশ ও দেশের শাসকেরা তাকে কিছুই দেয়নি। স্বার্থবাদী মানুষের স্বার্থপরতা আর জটিলতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম আসেনি। জীবনের শেষ সময়ে এসে চরম আর্থিক দুরবস্থার মুখে পড়ে অনেকটা অবহেলা আর বিনা চিকিৎসায় শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন জীর্ণ পোশাক পরে। দেশবিরোধী শক্তির ধারকেরা যখন স্বাধীন বাংলার পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে দেশের মানুষের অর্থে আয়েশী জীবন যাপন করেছেন তখনই মুক্তিযুদ্ধের এ আপোসহীন মানুষটির দিন কেটেছে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে। তবু তিনি কারও কাছে কিছু চাননি। এ রাষ্ট্রের শাসকদের প্রতি তার কোনো অভিযোগও ছিল না। মানুষের জন্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। স্বজনদের ছেড়ে আর আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হবার জন্য এক বুক যন্ত্রণা নিয়েই ২০০৮ সালের ১৫ মার্চ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ।

মূল্যায়নে অবহেলা[সম্পাদনা]

তিনি তার বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিলিয়েছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। সেই মহান মানুষটি যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি তার জীবদ্দশায়। মরণের যাত্রায়ও মেলেনি ন্যুনতম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। তার জন্য সীমাহীন এই অবহেলার পেছনের কারণ এটাই যে, তিনি কেবল বিলিয়েই গেছেন, প্রতিদানে চাননি কিছুই। আজীবন বিপ্লবী বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকাই বুঝি তার অপরাধ। বুর্জোয়া রাজনীতির বিরোধিতা আর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নোংরা প্রতিহিংসার কারণে রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিপ্লবী কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদের জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল বড়ই আমানবিক। আজো ভালো নেই তার পরিবারের সদস্যরা। স্বাধীনতার পর আটত্রিশ বছরেও মেলেনি সামান্যতম স্বীকৃতি।

কিছু মানুষ আজীবন স্বপ্ন দেখে যায়। সে স্বপ্ন রাস্তবায়নের জন্য আজীবন পরিশ্রম করে। নিজের মেধা, অর্থ আর শ্রম সবকিছু বিলিয়ে মানুষের চোখে প্রত্যাশা পূরণের হাসি ফোটাতে চায়। অনিয়ম, অপরাজনীতি, বিদেশি শক্তির আগ্রাসন আর দেশবিরোধী অপশক্তির বিলোপের মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে চায়। এ মুক্তির জন্য পুরোনো জীর্ণ ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করতে চায় নতুন সমাজ; যে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য-শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। এমন সুখী সমৃদ্ধিশালী যুদ্ধাপরাধী মুক্ত এক বাংলাদেশের স্বপ্নদষ্ট্রা ছিলেন উত্তর জনপদের প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজীবন বিপ্লবী কমরেড ছয়ের উদ্দিন আহমেদ। জন্মদাতা পিতার অনৈতিক কাজের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তিনি যে বিপ্লবী জীবনের সূচনা করেছিলেন তার সমাপ্তি হয়েছিল চরম অবহেলা আর অমানবিক অবস্থার শিকার হয়ে। তবু নীতি-আদর্শে অটুট ছিলেন তিনি। তাই তো রংপুর তথা উত্তর জনপদের কৃষক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গেলে বিপ্লবী এ নেতাকে বাদ দেওয়া অসম্ভব।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]