আব্দুর রাজ্জাক (রাজনীতিবিদ)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আব্দুর রাজ্জাক
ফরিদপুর-১৬ আসনের
সংসদ সদস্য
কাজের মেয়াদ
৭ মার্চ ১৯৭৩ – ৬ নভেম্বর ১৯৭৬
শরীয়তপুর-৩ আসনের
সংসদ সদস্য
কাজের মেয়াদ
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
কাজের মেয়াদ
১২ জুন ১৯৯৬ – ২৩ ডিসেম্বর ২০১১
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৯৪২-০৮-০১)১ আগস্ট ১৯৪২
ডামুড্যা, শরীয়তপুর, বাংলাদেশ
মৃত্যু২৩ ডিসেম্বর ২০১১(২০১১-১২-২৩)
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
বাংলাদেশ
রাজনৈতিক দলবাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
দাম্পত্য সঙ্গীফরিদা রাজ্জাক
সন্তান
প্রাক্তন শিক্ষার্থীঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবিকাআইনজীবী, রাজনীতিবিদ

আব্দুর রাজ্জাক (১ আগস্ট ১৯৪২ - ২৩ ডিসেম্বর ২০১১) ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের অন্যতম ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ৫০’র দশকের শেষের দিকে। মৃত্যুর পূর্বাবধি তিনি শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। ১৯৯১, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে ২টি ক'রে আসনে সাংসদ নির্বাচিত হন। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৬৬-১৯৬৭ ও ১৯৬৭-১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ ও ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।[১]

জন্ম ও শিক্ষা[সম্পাদনা]

রাজনীতিবিদ আব্দুর রাজ্জাক শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইমাম উদ্দিন এবং মাতার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা। তিনি ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং পরে মাস্টার্স পাস করেন। এরপর তিনি এলএলবি পাস করেন এবং ১৯৭৩ সালে আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিল’র নিবন্ধিত হন।

ছাত্ররাজনীতি[সম্পাদনা]

আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে। তিনি ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহঃ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুই বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ’৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন[সম্পাদনা]

পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৪ সালে প্রথম তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ’৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। কারাগার থেকেই মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা[সম্পাদনা]

মুক্তিযুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার (মুজিব বাহিনীর ৪ সেক্টর কমান্ডারের একজন) ছিলেন। তিনি মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষকও ছিলেন। তিনি দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুজিব বাহিনী গঠনে অন্যতম রূপকার ছিলেন। মুজিব বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (Bangladesh Liberation Forces - BLF) (বাংলা:বাংলাদেশ স্বাধীনতা বাহিনী)৤

স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি[সম্পাদনা]

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যা করার পর আব্দুর রাজ্জাক পুনরায় গ্রেপ্তার হন। ’৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দী ছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়। আব্দুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।[২] ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ফরিদপুর-১৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৩] ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৪][৫][৬][৭]

বাকশাল[সম্পাদনা]

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করা হয়। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। ইতোমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করলে আওয়ামী লীগ পুনগর্ঠিত হয় এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উদ্যোগী হয়ে পুনরায় বাকশাল (রাজ্জাক) গঠন করেন এবং ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই বাকশালের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদের পতনের পর তিনি বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

মন্ত্রিসভা সদস্য[সম্পাদনা]

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে।

দেহাবসান[সম্পাদনা]

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।[১] মৃত্যুর আগে তিনি লন্ডনের কিংস হসপিটালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডাক্তারদের পরামর্শে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়ার পর ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫০ মিনিটে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।[৮] তার বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক এবং দুই পুত্র নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম রাজ্জাক। ২৫ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ১২টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ। অতঃপর সেখান থেকে নেওয়া হয় তার গুলশান বাসভবনে। প্রথম নামাজে জানাজা বেলা ৩টার পরপরই জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে আবদুর রাজ্জাকের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১০টায় হেলিকপ্টারযোগে আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ তার জন্মস্থান শরীয়তপুরের ডামুড্যায় নেওয়া হয়। সেখানে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠানের পর ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. নিজস্ব প্রতিবেদক (২৩ ডিসেম্বর ২০১১)। "চলে গেলেন আব্দুর রাজ্জাক"দৈনিক প্রথম আলো। ২০২০-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ আগস্ট ২০২০ 
  2. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ 
  3. "১ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. "৫ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. "৭ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  6. "৮ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  7. "৯ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা"জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ২০১৬-১১-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২৯ 
  8. "চলে গেলেন আব্দুর রাজ্জাক"বিবিসি বাংলা। ২৪ ডিসেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২৯ আগস্ট ২০২০