কালীঘাট মন্দির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কালীঘাট মন্দির
কালীঘাট মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
অবস্থান
অবস্থানকালীঘাট, কলকাতা
স্থাপত্য
ধরনমধ্যযুগীয় বাংলার মন্দির স্থাপত্য, আটচালা
কালীঘাট কালী মন্দিরের মা কালীর মূর্তি

কালীঘাট মন্দির কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর রূপে পূজিত হন। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল। পুরাণ মতে এ স্থান বারাণসী তুল্য । কবি ভরতচন্দ্রের লেখাতে পাওয়া যায়,

"কালীঘাটে চারিটি অঙ্গুলি ডানি পার,
নকুলেশ ভৈরব,কালিকা দেবী তার।..."

বলা হয় বেহালা থেকে ২ যোজন ব্যপি কালি ক্ষেত্রের ৩ প্রান্তে অবস্থিত স্বয়ং ব্রহ্মা , বিষ্ণুশিব আর তার মাঝেই দেবীর অবস্থান। দেবী এখানে ভৈরবী , বগলা , মাতঙ্গী , বিদ্যা , কমলা , ব্রাহ্মী , মহেশ্বরী , চণ্ডী প্রভৃতি রূপে পূজিতা । দীপান্বিতা অমাবস্যাতে দেবীকে মহালক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয়।

পৌরাণিক কিংবদন্তি[সম্পাদনা]

সতীপীঠ কালীঘাট[সম্পাদনা]

সত্যযুগে প্রজাপতি দক্ষ স্বগৃহে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে দেবতা, মুনি-ঋষি, যক্ষ, কিন্নর সকলকে নিমন্ত্রণ করলেও, দক্ষ আপন কন্যা সতী ও জামাতা শিবকে নিমন্ত্রণ জানাননি। সতী বিনা আমন্ত্রণে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলে, তাঁর সম্মুখেই যক্ষ শিবের নিন্দা করেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবিসর্জন দেন সতী। তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর শবদেহ স্কন্ধে নিয়ে বিশ্বধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। তাঁকে শান্ত করতে বিশ্বপালক বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সতীর খণ্ডবিখণ্ড দেহের টুকরোগুলি পৃথিবীর নানা স্থানে পতিত হয়েছিল। পৃথিবীতে পড়ামাত্রই এগুলি প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়। পীঠমালা তন্ত্র অনুযায়ী, সতীর ডান পায়ের চারটি আঙুল পড়েছিল কালীঘাটে।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

কালীঘাট একটি বহু প্রাচীন কালীক্ষেত্র। গবেষকদের মতে , "কালীক্ষেত্র" বা "কালীঘাট" কথাটি থেকে "কলকাতা" নামটির উদ্ভব। ধারণা করা হয় প্রায় ২০০০ বছর আগের গ্রীক দার্শনিক টলেমির ভারত বর্ণনাতে যে কালীগ্রামের কথা রয়েছে সেটিই আজকের কালীঘাট। এও জানা যায় যে ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে রচিত চণ্ডীমঙ্গলে বর্ণিত ধনপতি সওদাগর তার পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে সপ্ত ডীঙায় চরে আদিগঙ্গা দিয়ে যাবার সময় এখানে পূজা দিয়েছিলেন । মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচিত সেই চণ্ডীমঙ্গলে এও বর্ণিত আছে যে ,

"কালীঘাট এরাইল বেণীর নন্দন,

কালীঘাটে গিয়া ডিঙি দিল দর্শন।"

[২] জনশ্রুতি, আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামক এক মাতৃসাধক একদা এখানে কালীর ধ্যান করছিলেন। এরপর একরাতে তিনি দেবীর কন্ঠ শুনতে পান। তাকে বলা হয়, সে যে বেদীতে বসে ধ্যান করছিলেন সেটি ব্রহ্মবেদী( অর্থাৎ একদা ব্রহ্মা সেখানে বসে দেবীর ধ্যান করতেন), আর দেবীর সেই অঙ্গ পাশের কালীন্দি হ্রদে রয়েছে। তাকে এও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, নিলগিরী পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরী নামক একজন সাধক আছেন, তার কাছে যে কষ্টিপাথরের শিলাস্তম্ভ রয়েছে, তা যেন সেই ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করা হয়। এরপর আত্মারাম নীলগিরী গিয়ে ব্রহ্মানন্দের সাথে দেখা করেন। ধারণা করা হয় কোন দৈববলে সেই ১২ হাত লম্বা আর ২ হাত চওড়া সেই শিলাকে কালীঘাটে আনা হয়েছিল। বলা হয় তখন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেখানে আবির্ভূত হয়ে সেই শিলাকে মাতৃরূপ দেন আর তা ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করেন। এভাবে দেবীর স্থাপনা হলেও তখনও দেবীর সেই খণ্ডিত চরণ নিখোঁজ, এমতাবস্থায় একরাতে কালীন্দি হ্রদের পাশে সাধনাকালে আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দ হ্রদের ভেতরের একটি স্থান থেকে আলো দেখতে পান। পরদিন ভোরে তারা সেখানে মায়ের চরণাংশ পান। এটি ছিল স্নানযাত্রার দিন, অর্থাৎ জৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন। এদিন আজও প্রথা মেনে বিশেষ পূজা হয়। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেলে সন্তোষ রায়চৌধুরী সেগুলি সংস্কার করেন।[২] বর্তমান এই মন্দিরটি নব্বই ফুট উঁচু। মন্দিরের উপরে রয়েছে ৩ টি কলস , ১ টি ত্রিশূল ও ১ টি ত্রিকোণা ধাতব পতাকা যাতে 'ॐ' লিখিত। এটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা। সামনের নাটমন্দির তৈরি করেন আমদুলের জমিদার কালীনাথ রায়।[২] মন্দির সংলগ্ন জমিটির মোট আয়তন ১ বিঘে ১১ কাঠা ৩ ছটাক; বঙ্গীয় আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মূল মন্দিরটির আয়তন অবশ্য মাত্র ৮ কাঠা। গর্ভগৃহটি সুউচ্চ। পরবর্তীতে রাজস্থানী শিল্পীদের দ্বারা এর ছাদ নতুন করে সাজানো হয়েছে। [২] মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, শিব প্রভৃতি দেবতা পূজিত হন।কালীঘাট মন্দিরের নিকটেই পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির। ১৮৫৪ সালে তারা সিং নামে জনৈক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী বর্তমান নকুলেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। শিবরাত্রিনীলষষ্ঠী উপলক্ষে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। কালীমন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে শ্যাম রায়ের মন্দির। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখানে রামনবমীদোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৬২ সালে শবদাহের জন্য মন্দিরের অদূরে নির্মিত হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশান। বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে এই শ্মশানে। এখানকার শ্মশানকালী পূজা বিখ্যাত।

মূর্তি[সম্পাদনা]

কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মায়ের মাথা সোনার মুকুটে শোভিত । রয়েছে সোনার তৈরি লম্বা জিভ যেটি গড়িয়ে দিয়েছিলেন পাইক পাড়ার রাজা ইন্দ্র চন্দ্র সিংহ এবং রুপোর তৈরি চারটি হাত যা তৈরি করে দিয়েছিলেন খিদিরপুরের গোকুল চন্দ্ৰ ঘোষাল। সেই হাত পরে সোনার করে দিয়েছিলেন কালী চরণ মল্লিক। ১০৮ সোনার মুন্ড মালা দান করেছিলেন ১৭৬৫ সালে পাতিয়ালার মহারাজ রাজা নবকৃষ্ণ। এছাড়া দেবীর মাথার উপরের সোনার ছাতা দান করেছিলেন নেপালের সেনাপতি জঙ্গ বাহাদুর। এছাড়াও আরও কয়েকটি সোনার ও রূপার ছাতা রয়েছে। চারহাতের চারগাছি সুবর্ণ কঙ্কণ চড়কডাঙা নিবাসী কালীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদান করেন। মায়ের পদতলে রয়েছেন ১ মন ওজনের রূপার শিব। পেছনে রয়েছে ২৫ কেজি রূপার তৈরি নকশা করা চালচিত্র। উপরের বাম হাতে আছে ২ কেজি ওজনের সোনার খড়্গ । নিচের বাম হাতে আছে ১টি সোনার মুন্ড। ডান দিকের২ হাতে রয়েছে বর ও অভয় মুদ্রা । এইরূপ বহু স্বর্ণালংকার বহু ধনাঢ্য লোকের দ্বারা প্রদানকৃত । ১টি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে; এটি কারোর সম্মুখে বের করা হয় না আর এটি ব্রহ্মবেদীর নিচে রয়েছে।

পূজা[সম্পাদনা]

প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপুজোদীপান্বিতা কালীপুজোর দিন মন্দিরে প্রচুর ভক্ত ও পু্ণ্যার্থীর সমাগম ঘটে।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. পীঠমালা তন্ত্রের শ্লোকটি হল:

    যুগাদ্যায়ং মহাদেব দক্ষাঙ্গুষ্ঠং পদোমম
    নকুলীশঃ কালীপীঠে দক্ষপদাঙ্গুলি সু চ মে
    সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।।

    বঙ্গানুবাদ: "কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ। সকল পীঠস্থানের শ্রেষ্ঠ। কালীপীঠের দেবী মহাশক্তিস্বরূপিণী কালী। আর পীঠরক্ষক হলেন ভৈরব নকুলেশ্বর। এখানে পুজো দিলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কালীঘাটের দেবী কালিকা সর্বসিদ্ধিকারী।"

    --

    কালীক্ষেত্র কালীঘাট, সুমন গুপ্ত, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১৩

  2. "কালীঘাটের কালীমন্দির", বাংলার ঐতিহ্য: কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৬৯-৭০