বাস্তুগোলক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
একটি পড বাস্তুসংস্থান

বাস্তুগোলক (ইংরেজি: EcoSphere বা Original Ecosphere) হচ্ছে কাচ নির্মিত আবদ্ধ একটি পরিবেশ। এটির আকার হতে পারে একটি ফুটবলের সমান। একটি ইকোসিস্টেমে যা যা থাকে তার সবই আছে এতে, জীবী অজীবী প্রাণী ও পরিবেশ। এর ভেতরে প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে চিংড়ি মাছ, শামুক, ব্যাক্টেরিয়া ও অণুজীব। গাছের মধ্যে আছে শৈবাল আর অজীবীদের মধ্যে আছে পরিশ্রুত সমুদ্র-জল হাওয়া ঝিনুক কাঁকড় ইত্যাদি। স্বচ্ছতার কারণে এই গোলকের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে আলোক যা আরেকটি অজীবী। গড়পড়তা ১৫ বছরের দীর্ঘজীবীতা এবং বৈরি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার জন্যে এই গোলকে বসবাসের জন্যে নির্বাচন করা হয় হাওয়াই দ্বীপের আকর্ষণীয় লাল রঙের চিংড়ি। আকারে মাত্র এক সেন্টিমিটারের মতো লম্বা এই চিংড়িগুলি আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত শিলাসমৃদ্ধ জলাশয় এনকেয়ালিন (Anchailine) গুলিতে বাস করে। মূলত এই শৈবাল চিংড়ি মাছের শরীরের সঙ্গে বাহিত হয়ে গোলকে চলে যেতে পারে। কখনো খুব ছোট প্রজাতির শামুক দেখা যায় গোলকে, সিস্টেম নির্মাণে যার তেমন প্রয়োজন না হলেও বেশ দৃষ্টিনন্দন। এতে আছে অন্যতম উপাদান স্পিরুলিনা শৈবাল যা দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।

বাস্তুগোলকে ভারসাম্য রক্ষার জন্যে সকল উপাদানের পরিমাণ বেশ হিসাব-নিকাশ করেই দেয়া হয়। অতিরিক্ত যে কোনো কিছুই একটি ইকোসিস্টেমকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। এমনটা ঘটেছিলো যখন অস্ট্রেলিয়াতে খরগোসের একটি প্রজাতিকে প্রবর্তন করা হল। মাঠের ভেতর গর্ত করে এই খরগোস বাসা তৈরি করলো যেখানে আগে থেকে বাস করতো বিভিন্ন রকম প্রাণী। খরগোসের খাদ্য ও বাসস্থানের প্রতি আগ্রাসনে এসব প্রাণীদের লুপ্ত হবার অবস্থা দেখা দিল, এখন যা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গোলকটি রাখতে হয় স্বল্পালোক যাতে শৈবালের পরিমাণ অতিমাত্রায় বেড়ে না যায়। কারণ এতে এমোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পানির অম্ল-ক্ষার অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে, প্রাণীদের জীবনের প্রতি হুমকি আসতে পারে। তবে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে এই চিংড়ি ১৫-২০ ডিগ্রিতে আরামে থাকলেও, অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু বলে আয়েশী তাপমাত্রার অনেক হেরফের হলেও এরা বংশবিস্তার না করতে পারলেও বেঁচে থাকতে পারে। গোলকে কখনো হয়ত দেখা যায় দুয়েকটি চিংড়ি বা শামুক মারা যাচ্ছে, এর কারণ সম্ভবত এদের আয়ু। চিংড়ি-শামুক গোলকের অভ্যন্তরে ঢোকানোর সময় এদের আয়ুষ্কাল নির্ণয়ের ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ পরীক্ষাটা করা হয় না। আর যদি একসঙ্গে অনেক মাছ বা শামুক মারা যায় তবে স্বাভাবিকভাবে বুঝতে হবে এর ভেতরে তাপমাত্রার অসহনীয় পরিবর্তন ঘটেছে বা শৈবালের অত্যধিক বিস্তারের কারণে পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। গোলকের ভেতরে যে পাংখা কোরাল রাখা হয়, তা ক্যালসিয়াম কারবোনেট দিয়ে তৈরি যা জলের pH ফ্যাক্টরের ভারসাম্য রক্ষা করে।

এই বাস্তুগোলক সম্পূর্ণ আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে কাজ করে তা বেশ লক্ষণীয় বিষয়। মূলত সূর্যালোক বা কৃত্রিম আলোক থেকে শৈবাল সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করে খাবার এবং ত্যাগ করে অক্সিজেন। চিংড়ি, শামুক, ব্যাক্টেরিয়া এই অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং যে কার্বন-ডায়-অক্সাইড ত্যাগ করে তা পুনরায় সূর্যরশ্মির উপস্থিতিতে খাদ্য তৈরিতে গ্রহণ করে শৈবাল। চিংড়ি-শামুক, শৈবাল ও তাদের ওপরে জমা থাকা গাদ খেয়ে থাকে। চিংড়ি মাছ মাসে দুবার খোলস পালটায়। সেই খোলস অনুজীবেরা বিশ্লিষ্ট করে খাদ্য-উপযোগী করে তোলে। কোনো মাছ মরে গেলে তা সাধারণত অন্য মাছ খেয়ে ফেলে। গরগোনিয়া কোরাল বা পাংখা-প্রবালেরর গাছে চিংড়ি মাছ বিশ্রাম নিতে পারে, এর শরীরে জমে থাকা কিছু খাদ্যও পেতে পারে। কখনো গোলকের ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের থেকে বেশি হলে ভেতরে বাষ্প জমে যায় বিন্দু বিন্দু আকারে। এই ঘনীভবনের কারণে কখনো কখনো গোলকে জলের পরিমাণ কম-বেশি দেখা যায়। রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এই গোলকের ভেতরে থাকে একটি ম্যাগনেটিক কয়েন যার উপরিভাগ জালের মত কাপড় দিয়ে আটকানো। কখনো কাচের গোলকের ভেতরের দিকটা পরিষ্কার করতে চাইলে বাইরে একটি চুম্বক ধরে আস্তে আস্তে ঘষে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়। এই গোলক কখনো CRT টেলিভিশনের ওপরে, মাইক্রোওয়েভ চুল্লীর কাছে রাখা ঠিক নয় কারণ রেডিয়েশনের কারণে জীবীদের অসামান্য ক্ষতি হতে পারে। কখনো এসব গোলক রোদে রাখা যাবে না, কারণ হঠাৎ করে শৈবালের অস্বাভাবিক বংশ বিস্তার ঘটে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এই গোলক আদতে NASA-র মহাকাশ গবেষণার একটি অনন্য ফসল। মহাশূন্যে প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্যে আমেরিকার এস্ট্রোনট এবং রাশিয়ার কসমোনটদের শূন্যে এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে দীর্ঘদিনের জন্যে অবস্থান করার প্রয়োজন হয়। সেখানে পৃথিবী থেকে খাবার নেয়া এক বাড়তি খরচ ও ঝামেলা। এর চেয়ে যদি মহাশূন্যে কোনো ইকোসিস্টেম চালু করা যায় তবে তা হবে একটি স্বনির্ভর খাদ্য ও পরিবেশ নির্মাণের কারখানা। এই ধারণা থেকেই নাসা-র বিজ্ঞানী জো হ্যানসেন ও ক্লেয়ার ফলসাম ক্যালফোর্নিয়ার “জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরি”-তে এর উদ্ভাবন করেন, আশির দশকের শুরুতে। কয়েক বছরের মধ্যেই এর সফল বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয় আমরা একে ব্যবহার করছি অদ্ভুত এক গৃহসজ্জার উপকরণ হিশেবেও, যে কারণে উৎপাদনকারী সংস্থা একে যথসম্ভব আকর্ষণীয় করে তৈরির চেষ্টা করছেন।

বাণিজ্যজাত এই বাস্তুগোলকের ব্যাস এখন ১০ সেন্টিমিটার থেকে বড় হতে হতে ১ মিটারে এস পৌছেছে যা সাধারণত ব্যবহার করা হয় বৈজ্ঞানিক যাদুঘরগুলিতে। অদূর ভবিষ্যতে স্পেস-স্টেশন এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে যে স্বনির্ভর বসতির কল্পনা করছে মানুষ তার জন্যে বেশ বড় আকারের বায়োস্ফিয়ার দরকার হবে যা অনেকগুলি ইকোসিস্টেম বা বায়োম-এর সমন্বয়ে তৈরি হতে পারে। ১৯৭২ সনে এমন ধরনের আবদ্ধ ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে রাশিয়ার ক্রাসনাইয়ার্স্ক-এ এবং ১৯৯১ সনে আমেরিকার আরিজোনা মরুভূমিতে। ৪০ একর জায়গা জুড়ে আরিজোনার বায়োস্ফিয়ার-২ এর ভেতরে তৈরি করা হয়েছে বর্ষাবন, সমুদ্র, তৃণভূমি, মরুভূমি, কৃষিভূমি ইত্যাদি বায়োমসমূহ। আমাদের দেশে বড় ধরনের ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারলে অনেক ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হতে পারে। আমেরিকা বা রাশিয়ার ইকোসিস্টেমের গবেষণা আমাদের অভিজ্ঞতা লাভে সাহায্য করলেও আমাদের ইকোসিস্টেম আমাদেরই তৈরি করতে হবে যার ভেতরে থাকবে আমাদের দেশের হাওয়া-জল-মাটির পরিবেশ, দেশীয় উদ্ভিদ প্রাণী ব্যাক্টেরিয়া ও অনুজীব।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]