সৈয়দ মাহমুদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ (সাইয়িদ মাহমুদ নামেও পরিচিত) (২৪ মে ১৮৫০ – ৮ মে ১৯০৩) ছিলেন এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারক। তিনি ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পূর্বে তিনি ১৮৮২ সাল থেকে চার দফায় তিনি অস্থায়ী বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সৈয়দ মাহমুদ এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ভারতে হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম মুসলিম। মোহামেডান এংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার পিতা সৈয়দ আহমদ খানের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই কলেজ পরে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তর হয়। আইনবিদ হিসেবে তার রায় এলাহাবাদ সিরিজের ইন্ডিয়ান ল রিপোর্টে ভূমিকা রেখেছে। প্রস্তাবিত আইন বিষয়ে তিনি গভর্নর জেনারেলের ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আইন পরিষদে দীর্ঘ মত দিয়েছেন। সৈয়দ মাহমুদ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও আওধের আইন পরিষদে ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন।

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

স্যার সৈয়দ আহমদ খানের দ্বিতীয় ছেলে সৈয়দ মাহমুদ ১৮৫০ সালে দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কর্মসূত্রে তিনি মুরাদাবাদ, গাজীপুরআলিগড়ে পড়াশোনা করেছেন। দিল্লির গভর্নমেন্ট কলেজ ও বেনারসের কুইনস কলেজেও তিনি লেখাপড়া করেছেন। ১৮৬৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ইংল্যান্ডে পড়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি লাভ করেন।[১]

১৮৬৯ সালে সৈয়দ মাহমুদ লিঙ্কনস ইনে ভর্তি হন এবং ১৮৭২ সালে কল টু দ্য বার হন। পাশাপাশি ১৮৭০ সাল থেকে ক্যামব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে তিনি ল্যাটিন, গ্রীক ও প্রাচ্য ভাষাসমূহ নিয়ে দুই বছর পড়াশোনা করেছেন।[২][৩]

আইনপেশা[সম্পাদনা]

ভারতে ফেরার পর সৈয়দ মাহমুদ ১৮৭২ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে যোগ দেন। এই আদালতে এই পদ অর্জনকারী তিনি প্রথম ভারতীয়। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যারিস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরের বছর ভাইসরয় লর্ড লিটন তাকে আওধের জেলা ও সেশন জজ হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এরপর তাকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সংক্ষিপ্তকালের জন্য তিনি হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের কাছে প্রেরিত হন। ১৮৮১ সালে তিনি সেখানের আইন প্রশাসনে সহায়তা করেন।[৪]

১৮৮২ সালে সৈয়দ মাহমুদ উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮৮৭ সালে পূর্ণ নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি অস্থায়ীভাবে দায়িত্বপালন করেছেন।[৫] তার সমসাময়িকরা তার ব্যতিক্রমী দক্ষতা ও আরবি ভাষার জ্ঞানের কারণে আলাদা হিসেবে দেখতেন। ক্যামব্রিজে তিনি আরবির জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মুসলিম আইনের ব্যাখ্যায় তার এই জ্ঞান ফলদায়ক ছিল। দীর্ঘ ও বিস্তারিত রায়ের কারণে তিনি পরিচিত। এগুলোর অনেকই ল রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৭৭ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত ভাইসরয়ের আইন পরিষদের আইন মন্ত্রী উইটলি স্টোকস তার এংলো-ইন্ডিয়ান কোডস বইয়ে মাহমুদের রায়ের প্রশংসা করেছেন।[৬]

অবসরগ্রহণের পর সৈয়দ মাহমুদ ব্যারিস্টার হিসেবে পুনরায় কাজ শুরু করেন। ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও আওধ আইন পরিষদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি লখনৌয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে কাজ করেছেন।

শিক্ষাবিস্তার[সম্পাদনা]

১৮৭২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর সৈয়দ মাহমুদ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ভারতে মুসলিমদের জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন।[৭] এরপর তিনি তার সৈয়দ আহমদ খানকে মোহামেডান এংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ গড়তে সহায়তা করেন। আইনজীবী ওবিচারক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি এখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৮৮৩ সালে কলেজের প্রিন্সিপল হিসেবে দায়িত্বপালনের জন্য থিওডর বেককে নিয়োগ দিতে তিনি ইংল্যান্ড যান। ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষকতায়ও তিনি অংশ নেন। কলেজের আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তিনি ভূমিকা রেখেছেন এবং তার ব্যক্তিগত আইনের বইয়ের সংগ্রহ থেকে অনেক বই এতে দান করেছেন।[৮] ১৮৮৯ সালে তার পিতা কলেজের বোর্ড অব ট্রাস্টিসের জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে তাকে মনোনীত করে যান। ১৮৯৮ সালে তার পিতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মৃত্যুর পর তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরের বছর এই পদে নবাব মুহসিন উল মুলককে জয়েন্ট সেক্রেটারির বদলে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়।

সৈয়দ মাহমুদ এর বাইরেও শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন। রিপনের প্রশাসনে তিনি ১৮৮২ সালের শিক্ষা কমিশনে তিনি অন্যতম কমিশনার ছিলেন। এছাড়াও নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ মানমুদ একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ১৮৯৩ ও ১৮৯৪ সালের বার্ষিক বৈঠকে তিনি ইংরেজি শিক্ষার ইতিহাসের উপর বক্তব্য রেখেছেন।

পরিবার[সম্পাদনা]

১৮৮৮ সালে সৈয়দ মাহমুদ তার বাবার মামাত ভাই নওয়াব খাজা শরফুদ্দিন আহমেদের মেয়ে মুশাররফ জাহানকে বিয়ে করেন। রোস মাসুদ নামে তার এক সন্তান ছিল। এলাহাবাদে তিনি একটি বাড়ি কিনেছিলেন। পরে তা মোতিলাল নেহেরুর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। মোতিলাল নেহেরুও এসময় এলাহাবাদ আদালতে ব্যারিস্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর এর নাম বদলে স্বরাজ ভবন রাখা হয়।[৯] ১৮৭৬ সালে সৈয়দ মাহমুদ আলিগড়ে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে এখানে স্যার সৈয়দ একাডেমি অবস্থিত। ১৯০০ সালে তিনি সীতাপুরে তার চাচাত ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ আহমেদের কাছে চলে আসেন। ১৯০৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই অবস্থান করেন।

রচনাকর্ম[সম্পাদনা]

সৈয়দ মাহমুদের প্রথম রচনা হল উর্দুতে অনুবাদ করা সাক্ষ্য আইন ও এর সংশোধনী। ১৮৭৬ সালে এটি প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালে এ হিস্ট্রি অব ইংলিশ এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া শিরোনামে তার বক্তব্য প্রকাশিত হয়।[১০] আলিগড় ইনস্টিটিউট গেজেটক্যালকাটা রিভিউতে তিনি নিবন্ধ লিখেছেন। তবে তার মূল রচনাকর্ম হিসেবে ইন্ডিয়ান ল রিপোর্ট:এলাহাবাদ সিরিজকে গণ্য করা হয়। সমসাময়িকদের বর্ণনা অনুযায়ী অবসরের পর মুসলিম আইন নিয়ে কয়েক খন্ডের রচনা নিয়ে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে তার মৃত্যুর ফলে তা অসমাপ্ত থেকে যায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Guenther 2004, p. 41-42.
  2. "Mahmood, Syed Mohammad (MHMT870SM)"A Cambridge Alumni Databaseকেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় 
  3. Kozlowski 2008, p. 118-119.
  4. Guenther 2004, p. 73-80.
  5. Guenther 2004, p.80-81.
  6. Stokes 1887, p. xxviii.
  7. Husain, Yusuf 1967, p. 222-237.
  8. Guenther 2004, p. 101-103.
  9. Lelyveld 2004.
  10. Mahmood 1895.
  • Banerji, Satish Chandra. "Syed Mahmood: Recollections and Impressions," The Hindustan Review and Kayastha Samachar n.s. 7, no. 3 (1903): 439–443.
  • Guenther, Alan M. "Syed Mahmood and the Transformation of Muslim Law in British India." Ph.D. Dissertation, McGill University, 2004.
  • Hidayatullah, M. "Justice Syed Mahmood," in A Judge's Miscellany. Bombay: N. M. Tripathi, 1972.
  • Husain, Iqbal, ed. Justice Syed Mahmood Papers. Aligarh: Sir Syed Academy, Aligarh Muslim University, 2005.
  • Husain, Yusuf, ed. Selected Documents from the Aligarh Archives Bombay: Asia Publishing House for the Department of History, Aligarh Muslim University, 1967.
  • Kozlowski, Gregory C. Muslim Endowments and Society in British India. (Reprint ed.). Cambridge: Cambridge University Press, 2008. আইএসবিএন ৯৭৮০৫২১০৮৮৬৭১
  • Lelyveld, David. Aligarh's First Generation: Muslim Solidarity in British India. Princeton: Princeton University Press, 1978.
  • Lelyveld, David. "The Mystery Mansion: Swaraj Bhavan and the Myths of Patriotic Nationalism," The Little Magazine4, no. 4, "Ghosts" 2004.
  • Mahmood, Syed. A History of English Education in India: Its Rise, Development, Progress, Present Condition and Prospects. Aligarh: M.A.-O.College, 1895.
  • "Mahmood Number" Aligarh Law Journal 5 (1973).
  • Sapru, Tej Bahadur. "Syed Mahmood, as a Judge," The Hindustan Review and Kayastha Samachar n.s. 7, no. 3 (1903): 443–452.
  • Stokes, Whitley. The Anglo-Indian Codes, vol. 1, Substantive Law. Oxford: Clarendon Press, 1887.
  • Uttar Pradesh (India). High Court of Judicature. Centenary: High Court of Judicature at Allahabad, 1866–1966, 2 vols. Allahabad: Allahabad High Court Centenary Commemoration Volume Committee, 1966.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]