সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে অবস্থিত পূজামণ্ডপ

সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি সুসং দুর্গাপুরে সোমেশ্বর পাঠকের বংশধররা তৈরি করেছিলেন।[১][২][৩]

অবস্থান[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরে নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুর। এ জেলার উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত এক জনপদের নাম। দুর্গাপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে সুসং দুর্গাপুরে জমিদার বাড়ি অবস্থিত। বর্তমানে জমিদার বাড়িটির একাংশ উপজেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।[৪]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

বৃহত্তর ময়মনসিংহে নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি। সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বর পাঠকের বংশধররা এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাংলা ১৩০৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে জমিদার বাড়িটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের বংশধররা এটি পুনঃনির্মাণ করেন। এ জমিদার বাড়িটি চারটি অংশে বিভক্ত। বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি, আবু বাড়ি ও দুই আনি বাড়ি। জানা যায়, ১২৮০ মতান্তরে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে কামরূপ কামাখ্যা থেকে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক ব্রাহ্মণ এ অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন। এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সোমেশ্বর পাঠক গারো রাজা বৈশ্যকে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্য দখল করে নেন। সে সময়ে সুসং রাজ্যের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ছিল আদিবাসী, যাদের অধিকাংশই আবার গারো। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর তার বংশধররা এ অঞ্চলে জমিদারী করে।

পরবর্তী তিন'শ বছর এই বংশের রাজ পুরুষগণ বহু উপাধী বদলিয়ে অবশেষে সিংহ উপাধী ধারণ করেন। এই রাজবংশের যোগ্য উত্তরসূরী মল্লযোদ্ধা এবং প্রখর কুটনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী রাজা রঘুনাথ সিংহ মোঘল সম্রাট আকবরের সিংহাসনোরাহনের পর তার সাথে এক চুক্তি করেন। এই চুক্তির অংশ হিসেবে রাজা রঘুনাথ সিংহকে মানসিংহ এর পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কোদার রায় এর বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয়। যুদ্ধে চাঁদ রায়, কেদার রায় পরাস্ত হলে রাজা রঘুনাথ সেখান থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন এবং রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন যা আজো দশভূজা মন্দির নামে সুপরিচিত। তখন থেকেই সু-সঙ্গের সাথে দুর্গাপুর যোগ করে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর৷[৫] এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩শ' ৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ' গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল দুর্গাপুর। বর্তমানে এটি নেত্রকোণার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তার পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামে এক রাজার শাসনামল থেকে সুসং রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজপরিবারে বিরোধের সূত্রপাত হয়। ফলে এক সময় গোটা রাজ্য চারটি হিস্যায় ভাগ হয়ে যায় এবং চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাড়িগুলো 'বড় বাড়ি', 'মধ্যম বাড়ি', 'আবু বাড়ি' (ছোট অর্থে) ও 'দু'আনি বাড়ি' নামে পরিচিত ছিল। '৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং পরবর্তীতে '৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হবার পর রাজবংশের সদস্যরা ভারতে চলে যান। আর এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে অনেক শৌর্য-বীর্যখ্যাত সুসং রাজ্যের।

সুসং রাজবাড়ি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। পরিখাবেষ্টিত রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল সৈনিকদের আবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ, অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা, হাতিশালা, রাজপরিবারের সদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাছারি, বৈঠকখানা ইত্যাদি। ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের রাজা জগতকৃষ্ণ সিংহ প্রাচীর চাপা পড়ে নিহত হন এবং রাজবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বর্তমানে যে নিদর্শনগুলো টিকে আছে তার অধিকাংশই জগতকৃষ্ণের পরবর্তী বংশধরদের নির্মিত।

বর্তমান অবস্থা[সম্পাদনা]

সুসং রাজাদের 'বড় বাড়ি'র সামনে তিনতলা একটি বড় ঘরকে 'রংমহল' বলা হতো। দেশ বিভাগের পরও ঘরটি ছিল। ১৯৭০ সালে সেখানে সুসং ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে কলেজ কর্তৃপক্ষ রংমহলের ভগ্নপ্রায় ঘরটি বিক্রি করে দেয়। একটি পানির ইঁদারা ও সীমানা প্রাচীর ছাড়া বড় বাড়ির কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই এখন। 'মধ্যম বাড়ি'র বাইরের পূর্ব দিকের একটি ঘর এখন দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বাড়ির একটি কাছারি ঘর ব্যবহৃত হচ্ছে দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে। ১৯৬৯ সালে মধ্যম বাড়ির অভ্যন্তরের কয়েকটি ঘর নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্গাপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এর মধ্যে দক্ষিণ পাশের একটি ঘর (রাজাদের বাসগৃহ) প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়, উত্তর দিকের ঘরটি (রাজাদের বাসগৃহ) বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ঘরটি এখনও শিক্ষক-শিক্ষিকার মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ বাড়িতে আর আছে একটি পুকুর যা এখনও 'রাজবাড়ির বড় পুকুর' নামে পরিচিত। 'আবু বাড়ি'তে স্বাধীনতার চার-পাঁচ বছর আগেও অমরেন্দ্র সিংহ শর্মা নামে সুসঙ্গ রাজবংশের এক সদস্য বসবাস করতেন। এলাকায় তিনি 'মিনি বাহাদুর' নামে পরিচিত ছিলেন। তার দেশত্যাগের পর ওই বাড়ির কয়েকটি ঘর বিভিন্ন সময় সরকারী কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই ঘরটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। এর ভেতর বাড়ির পেছনের ঘরটিতে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় 'সুসঙ্গ আদর্শ বিদ্যানিকেতন' নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এদিকে, দু'আনি বাড়ির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনও অক্ষত আছে। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন গোপাল দাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি রাজবাড়ির সাবেক কর্মচারী সাধুচরণ দাসের পৌত্র। এ বাড়ির সামনের ঘর (যেখানে রাজারা বসবাস করতেন), পুজোমন্ডপ ও পানির ইঁদারা আজও রাজবংশের স্মৃতি বহন করে চলেছে। পুজোমন্ডপটি 'নিত্যপূজামন্ডপ' হিসেবে পরিচিত। সেখানে আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো ছাড়াও সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় পুজো-পার্বণ হয়। কাঠের তৈরি এ ঘরগুলোর নির্মাণশৈলীও বেশ নান্দনিক। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

এছাড়াও দুর্গাপুরের সুসঙ্গ রাজাদের স্মৃতিচিহ্নকে আজও ধরে রেখেছে ১৯১৮ সালে স্থাপিত মহারাজা কুমুদচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, দশভুজা মন্দির (যেখানে সোমেশ্বর পাঠক প্রথম ধর্মীয় উপসনালয় স্থাপন করেছিলেন) ও রাজবাড়ির এক ম্যানেজারের বাসভবন। মহারাজা কুমুদচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়টি দুর্গাপুরের প্রথম উচ্চ বিদ্যালয়। বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ সরকারী। দশভুজা মন্দিরটি পরিচালিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে। এটি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম উপাসনালয়।[৬]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. BanglaNews24.com। "সুসং রাজ্যের রাজবাড়ী 'দু'আনি বাড়ি'"banglanews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৮ 
  2. "সুসং দুর্গাপুরে যা যা দেখতে পাবেন সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি || ভ্রমণ"জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য সুসং দুর্গাপুর"NTV Online। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৮ 
  4. "সুসং দুর্গাপুরে :: দৈনিক ইত্তেফাক"archive.ittefaq.com.bd (Bengali ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৮ 
  5. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০১৪-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৫-০৭ 
  6. দুর্গাপুর উপজেলা (নেত্রকোণা), বাংলাপিডিয়া