সামাজিকীকরণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দলগত খেলা, সামাজিকীকরণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানব শিশু সমাজের একজন কাঙ্ক্ষিত পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিসের মতে, "সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।" সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া একটি জীবনব্যাপী এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ পুরোপুরি সামাজিক মানুষ হিসেবে পরিণত হয়।[১]:[২]

সামাজিকীকরণ ছাড়া ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিত্ব লাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে একজন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা মানব শিশু ক্রমশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।

অগবার্ন নিমকফ বলেন, "সামাজিকীকরণ ছাড়া সমাজে জীবনযাপন একেবারেই সম্ভব নয় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার গোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশার সামাজিক মূল্য বজায় রাখে।"

উপাদান[সম্পাদনা]

একটি শিশুর একজন সমবয়সী বন্ধুর আচরণ মূলত অন্যদের আচরণকে প্রভাবিত করে এবং অন্যদের ব্যবহার দ্বারা বিকাশে শিশুটি নিজেও প্রভাবিত হয়। আচরণগত এই পারস্পরিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়াকে মিথস্ক্রিয়া (interaction) বলে। ব্যক্তির সামাজিকীকরণ সামাজিক পরিবেশ, সমাজ জীবন সামাজিক মূল্যবোধের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে।

  • সামাজিক পরিবেশ: যে বিশেষ সমাজব্যবস্থার মধ্যে মানুষ বাস করে তাকে সামাজিক পরিবেশ বলে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই মানুষ বিকশিত হয়। মানুষের অর্থনৈতিক, মানসিক ও নৈতিক জীবনের উপরও সামাজিক পরিবেশের প্রভাব রয়েছে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যে রয়েছে সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, বিধি-ব্যবস্থা, সকল প্রকার প্রবণতা, সমস্যা প্রভৃতি। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রযুক্তিগত পরিবেশ নিয়্র সামাজিক পরিবেশ গঠিত হয়। অর্থনৈতিক পরিবেশ সামাজিক পরিবেশের অংশ। প্রকৃতিতে মানুষ নানাবিধ সেবা ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করছে। এর মূলে রয়েছে মানুষের স্ব-সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। বাজার, জমিজমা, বাগান, গৃহপালিত পশু, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি অর্থনৈতিক উপাদান। তাছাড়া সামাজিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি মানুষের আচরণকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এগুলো সাংস্কৃতিক পরিবেশের অংশ। মানুষের সৃষ্টি করা উপাদানসমূহ নিয়ে সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠিত হয়। ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, আচার-আচরণ, জ্ঞান বিজ্ঞান সবই সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্তর্গত। মানুষের সামাজিকীকরণে সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয় এবং মনের প্রসারতা বাড়ে। ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের কারণে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে স্বীকৃত। ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের মূলে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কারণ। যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে প্রযুক্তিগত পরিবেশ বলে। এ পরিবেশও সামাজিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে। প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, যেমন- কম্পিউটার, টেলিভিশন, ইন্টারনেট মানুষের আচার-আচরণকে প্রভাবিত করে। দৈনন্দিন জীবনে ও আশেপাশের পরিবেশে সংঘটিত ঘটনাও মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।
  • সমাজ জীবন: সমাজ জীবন সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান। মানুষের সমাজ জীবন কতগুলো আচার-আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ যে সমাজে বসবাস করে, সে সমাজের জীবনধারা অর্থাৎ আচার-আচরণের সমষ্টিকেই সমাজ জীবন বলে। মানুষ সমাজের নানা কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এসব কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এসব কর্মসূচি ও সংশ্লিষ্ট আচরণের সাথে মানুষ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে অভিযোজনের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে মানুষ অন্যের আচরণ অনুকরণ করে কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করে। অর্থাৎ অনুকরণ প্রবণতা থেকে মানুষ ভাষা, উচ্চারণ, কথা বলার ধ্রুনসহ নানা বিষয় আয়ত্ত করে থাকে। সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় ভাষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। জন্মদিন, বিয়ে, ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী প্রভৃতি অনুষ্ঠান সমাজ জীবনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সমাজ জীবনের এসব অনুষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণে প্রভাব ফেলে।
  • সামাজিক মূল্যবোধ: মূল্যবোধ আধুনিক মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের বৈশিষ্ট্য। মানুষের জীবনধারার মান পরিমাপ করা যায় মূল্যবোধের মাধ্যমে। কারণ মূল্যবোধ অনুশীলনের মাধ্যমেই সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা, আচার-ব্যবহার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ব্যক্তি আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠে। সামাজিক মূল্যবোধ হলো সাধারণ সাংস্কৃতিক আদর্শ। এই আদর্শের দ্বারা সমাজের মানুষের মনোভাব, প্রয়োজন ও ভালোমন্দের নীতিগত দিক যাচাই করা যায়। মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক মূল্যবোধগুলো শিখে থাকে। সমাজের সকলের সমান সুযোগ-সুবিধা, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বোধ প্রভৃতি মূল্যবোধগুলো সকল সমাজেই রয়েছে। মানুষ সমাজ থেকে এ মূল্যবোধগুলো অর্জন করে থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের জীবনধারার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, একজন বাংলাদেশি বা ভারতীয় নাগরিকের মূল্যবোধ চীনাদের মূল্যবোধ থেকে পৃথক। বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবের ফলে তাদের জীবনধারায় আত্মিক উন্নতি, আধ্যাত্মিকতা, অপরের জন্য স্বার্থত্যাগ প্রভৃতি বিষয়ের উপর দ্বিত্বারোপ করে। অপরদিকে বৈষয়িক উন্নতি বা সমৃদ্ধিলাভই চীনাদের জীবনধারার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সামাজিক মূল্যবোধ ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে, যা ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা[সম্পাদনা]

সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে।

  • পরিবার: সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। পরিবারই শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি কাঁচামাল জোগায়, সংস্কৃতি নকশা জোগায় এবং পরিবারে পিতা-মাতা কারিগর হিসেবে কাজ করেন। কারণ শিশুর দৈহিক, মানসিক, পার্থিব ও অপার্থিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটায় পরিবার। কীভাবে কথা বলতে হবে, নিজের আবেগ কীভাবে প্রকাশ করা যায়, তা শিশু পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে। শিশু পরিবার থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও গ্রহণ করে, পরিবার থেকেই একটি শিশু আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
  • খেলার সঙ্গী: শিশুর সামাজিকীকরণে তার সঙ্গী বা খেলার সঙ্গীরা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশু তাঁর খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে মেলামেশা করলে তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি পরিস্ফুট হয়। সে স্বাবলম্বী হতে শেখে।
  • ধর্ম: ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। শৈশবকাল থেকে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সেই ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে লালিত হয় এবং সেই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ তথা সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ তথা সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়।
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সভ্য ব্যক্তিরা যাতে সামাজিক মূল্য, সামাজিক আদর্শ, সামাজিক অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করতে পারে সেজন্য প্রত্যেক সমাজ প্রতিটি সভ্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের শিক্ষাদান করে। সমাজ তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করে।
  • গণমাধ্যম: শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো গৌণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে, ম্যাগাজিন, বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি।
  • জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবেশী :নিজ পরিবার ব্যাতিত যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে তারাই আমাদের জাতিগোষ্ঠী।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ক্লোজেন, জন এ. (ইডি.) (১৯৬৮) সামাজিককরণ এবং সমাজ, বোস্টন: লিটল ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি
  2. Macionis, John J. (২০১৩)। Sociology (১৫তম সংস্করণ)। Boston: Pearson। পৃষ্ঠা ১২৬। আইএসবিএন 978-0133753271