গ্রিগোরি রাসপুতিন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(রাসপুতিন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
গ্রিগোরি রাসপুতিন
জন্ম(১৮৬৯-০১-২১)২১ জানুয়ারি ১৮৬৯
পোকরোভসকো, সাইবেরিয়া, রুশ সাম্রাজ্য
মৃত্যু৩০ ডিসেম্বর ১৯১৬(1916-12-30) (বয়স ৪৭)
সেন্ট পিটার্সবার্গ, রুশ সাম্রাজ্য
মৃত্যুর কারণগুপ্তহত্যা
পেশাকৃষক, তীর্থযাত্রী, আধ্যাত্মিক চিকিৎসক, পরামর্শদাতা
দাম্পত্য সঙ্গীপ্রসকোভা ফেডোরোনোভা ডুভ্রোবিনা
সন্তানমিখাইল, আন্না, গ্রিগরি, দিমিত্রি, মারিয়া, ভারভারা, পারাস্কেভা
পিতা-মাতাইয়েফিম রাসপুতিন এবং আন্না পারশুকোভাকে

রাসপুতিনবা গ্রেগরি ইয়েফেমোভিচ রাসপুতিন (রুশ: Григорий Ефимович Распутин, আ-ধ্ব-ব[ɡrʲɪˈɡorʲɪj (j)ɪˈfʲiməvʲɪtɕ rɐˈsputʲɪn];[১] 21 January [পুরোনো শৈলীতে 9 January] 1869  – 30 December [পুরোনো শৈলীতে 17 December] 1916 [২]) একজন রুশ সন্ন্যাসী, একজন অভিজ্ঞ পবিব্রাজক,[৩] (জন্ম: ১৮৭২ - মৃত্যু: ১৯১৬) তিনি এবং দ্বিতীয় নিকোলাসের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। রাজদম্পতির উপর তার প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া অনেকে তাকে চরিত্রহীন লম্পট এবং সে সময়ের রুশ রাজনীতিতে নানা ধরনের দুষ্ককর্মের হোতা বলে মনে করেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকায় রাজ দরবারের একদল বিশিষ্ট ব্যক্তি তাকে গুপ্তভাবে হত্যা করে।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা[সম্পাদনা]

Pokrovskoye in 1912
Rasputin with his children

রাসপুতিনের পুরো নাম গ্রেগরি ইয়েফেমোভিচ রাসপুতিন। রাসপুতিনের জন্ম হয় রুশ সাম্রাজ্যের তুরা নদীর তীরে পক্রভস্কায়া নামে সাইবেরিয়ার ছোট্ট একটি গ্রামে।[৪]ঐতিহাসিকদের মতে জন্মের তারিখ ২১ জানুয়ারী ১৮৬৯।[৫] রাসপুতিনের শৈশব সম্পর্কে যা জানা যায় তার পুরোটাই পারিবারিক সূত্র থেকে পাওয়া মৌখিক ইতিহাস। জানা যায় রাসপুতিনরা তিন ভাইবোন ছিলেন। তার বড় ভাই দামিত্রি এবং বোন মারিয়া। ছোটবেলা থেকেই রাসপুতিন ছিলেন ভবঘুরে চরিত্রের। রাসপুতিন ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম প্রসকোভা ফেডোরোনোভা ডুভ্রোবিনা।

সন্ন্যাস[সম্পাদনা]

রুশ সন্ন্যাসী রাস এবং জার দ্বিতীয় নিকোলাসের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাসপুতিনের উত্থানের শুরুটা হয়েছিল সাধারণ চাষি পরিবার থেকে। তুরা নদীর তীরে সাইবেরিয়ার ছোট্ট একটি গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। রাসপুতিনের বাবা ঘোড়া পালতেন। একবার তাদের কয়েকটা ঘোড়া চুরি হয়। ঠিক সে সময় রাসপুতিনের বালক বয়স। রাসপুতিন ঘোড়া চোরের নাম বলে দিয়েছিলেন। পরে তার কথা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে রাসপুতিনের কথাই ঠিক। পরে রটে যায় রাসপুতিনের আধ্যাতিক ক্ষমতা আছে। গ্রামের লোক বলাবলি করতে থাকে রাসপুতিন খ্রিস্টের আশীর্বাদপুষ্ট। ১৮ বছর বয়সে রাসপুতিনের মধ্যে ধর্মীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন তিনি তিন মাস কাটান ভার্কোটারি মনাস্ট্রিতে। এরপর তিনি যখন নিজ শহরে ফিরে আসেন, তখন তিনি এক পরিবর্তিত মানুষ। মনাস্ট্রিতেই তিনি আধ্যাতিক শক্তির চর্চা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ফিরে এসে তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রসকোভিয়া ফিয়োদরোভনাকে। তাদের তিন সন্তান ছিল। কিন্তু সংসার জীবনে থিতু হতে পারেননি রাসপুতিন। তাদের ফেলে এখানে ওখানে বাউলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি। এ সময় তিনি গ্রিস ও জেরুজালেম সফর করেন। তিনি মাঝে মধ্যে নিজ শহর পকরভস্কয়িতে ফিরে আসতেন আবার চলে যেতেন। সারাক্ষণ ভবঘুরে ছিলেন তিনি। আসলে এই সময়টায় তিনি সাধনা করে কাটিয়েছেন। ১৯০৩ সালে তিনি চলে যান পেত্রোগ্রাদে তথা সেন্ট পিটার্সবার্গে। তখন তিনি নিজেকে প্রথম ঘোষণা করেন এমন এক পবিত্র আধ্যাত্মিক গুরুজন হিসেবে। যার রয়েছে রোগমুক্তিরসহ নানা আধ্যাতিক ক্ষমতা। সেই সঙ্গে দাবি করেন ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার কথাও। এর আগে রাসপুতিনের বড় ভাই দামিত্রি ও ছোট এক বোন মারিয়া দুজনেই মারা যান। মৃগী রোগে আক্রান্ত বোনটি নদীতে ডুবে মারা যায়। বড় ভাই পুকুরে ডুবে পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ দুটি ঘটনা রাসপুতিনের জীবনে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল।

রাজদরবারে রাসপুতিন[সম্পাদনা]

রাশিয়ার সম্রাট জার দ্বিতীয় নিকোলাস ও সম্রাজ্ঞী জারিনা আলেক্সান্দ্রা বহু বছর ধরে নানা চেষ্টাসাধ্যি করেও তাদের কোনো উত্তরাধিকারী তথা পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হন। পরপর চার কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পর তারা পুত্রসন্তানের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এ জন্য তারা সব করতে রাজি ছিলেন। এক সময় তারা অনেক আধ্যাত্মিক পুরুষ ও সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত জারিনা আলেক্সান্দ্রা ১৯০৪ সালে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় আলেক্সি নিকোলায়েভিচ। জার ও জারিনা যেন তাদের উত্তরাধিকারের ভাবনা থেকে মুক্ত হলেন ঠিকই কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত এই সন্তান আক্রান্ত হলো হেমোপিলিয়া রোগে। যখনই আলেক্সির রক্তক্ষরণ শুরু হতো, তা আর বন্ধ হতো না। ধারণা করা হয় নিকোলাসের ভুলের কারণেই এমন বিপদ তৈরি হয়েছে। কারণ জার হিসেবে নিকোলাস প্রচুর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অ্যালেক্সজান্দ্রাকে বিয়ের পর এবং নতুন জার হিসেবে অভিষেকের সময় নিকোলাস তার প্রজাদের জন্য রাজকীয় ভোজের আয়োজন করেছিলেন যেখানে খাবার ও মদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে প্রায় দুই হাজার জনগণ মারা যায়। রাশিয়ার জনগণ জারের অভিষেক অনুষ্ঠানের এই ট্র্যাজেডিকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সন্তানের আরোগ্যের আশায় সম্রাট নিকোলাস ও আলেক্সান্দ্রা ছোটাছুটি করতে থাকেন হাকিম-কবিরাজ, ফকির-দরবেশ, যাজক-ভিক্ষু আর সন্ন্যাসীদের দরবারে। ১৯০৮ সালের আগে কিছুতেই কিছু যখন হলো না সন্তানের রক্তক্ষরণের এক পর্বে জারনন্দনের জন্য ডাকা হলো গ্রেগরি রাসপুতিনকে। শেষ পর্যন্ত রাসপুতিন জারপুত্র আলেক্সিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হন। সেই সূত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন সম্রাট পরিবারে। রাজ্যের বড় বড় চিকিত্সকরা যখন ব্যর্থ হচ্ছিলেন তখন রাসপুতিনের সাফল্য তার আধ্যাতিক ক্ষমতার প্রচার বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। রাজ পরিবারের নানা ঘটনা-অঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রাসপুতিন। অনেকে বলে জোঁক দিয়ে নাকি রাসপুতিন আলেক্সির রক্ত শুষে নিয়েছিল। জোঁকের লালায় থাকে হিরুদিন।

যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। আবার অনেকে বলে অ্যাসপিরিন দিয়ে নাকি আলেক্সিকে সারিয়ে তুলেছিল রাসপুতিন। অ্যাসপিরিন জিনিসটা ১৮৯৮ সাল থেকেই ইউরোপে পাওয়া যেত। কেউ বলেন রাসপুতিন এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন হিপনোটিজম। অন্যরা বলেন রাসপুতিন হিপনোটিজম পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। যাই হোক রাজপরিবারের উত্তরাধিকার আলেক্সি সেরে ওঠার পর জার নিকোলাস রাসপুতিনকে রাশিয়া ও জার-পরিবারের উপদেষ্টা ঘোষণা করেন। আর এভাবেই রাশিয়ান রাজ পরিবারে প্রবেশ করেন রাসপুতিন।

যৌনপিয়াসী ও মদ্যপ[সম্পাদনা]

রাসপুতিন ছিলেন প্রবল পরিমাণে মাদক ও যৌনপিয়াসী। যখন মদ খেতেন তখন তার কোনো হুশ থাকত না। আবার যৌনকার্যেও ছিলেন সমানভাবে উচ্ছৃঙ্খল। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মাত্রাজ্ঞানহীন। তাই অন্যদের কাছে তিনি ছিলেন নোংরা ব্যক্তিত্বের একজন। তিনি সমাজের মহিলাদের রাজনৈতিক আনুকূল্যের বদলে যৌন সম্ভোগ করতেন। নানা রকম শিষ্যও জুটেছিল রাসপুতিনের। শিষ্যদের সঙ্গেও তার যৌনতার নানা কথা প্রচলিত ছিল। নিজেকে আধ্যাত্মিকগুরু হিসেবে প্রচারের সময় সেন্ট পিটার্সবার্গ বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ শিষ্য জুটিয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে তত্কালীন রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছেছিলেন তিনি। সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিজাত ভক্তশিষ্যরাই অভিজাত মানুষের নানা সমস্যা নিয়ে রাসপুতিনের কাছে যেত। রাসপুতিন তার আধ্যাতিক ক্ষমতার জোরে সেসব সমস্যার সমাধান করে দিতেন। তখন থেকেই সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিজাত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা বাড়ছিল রাসপুতিনের। আসলে নারীরাই মুগ্ধ ছিল রাসপুতিনের প্রতি। আবার রাসপুতিনও নারীদের মুগ্ধ করার নানা কায়দা কানুন ব্যবহার করতেন। আর রাজপরিবারের উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে সম্রাটপত্নী জারিনা আলেক্সান্দ্রার ওপর রাসপুতিনের প্রভাব বাড়তে থাকে। রাসপুতিনের কথা ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর বলে ভ্রম করতে লাগলেন জারিনা আলেক্সান্দ্রা। যদিও সব রাশিয়ান বিশ্বাস করতে চায় না যে, রাসপুতিন ও জারিনা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন এবং তারা জার্মানদের সঙ্গে আলাদা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যদিও সে সময় এরকমই অভিযোগ উঠেছিল। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও জার্মানি ছিল পরস্পরের শত্রু। রাসপুতিনের সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। আর এর কারণেই বহু নারী রাসপুতিনের ওপর আকৃষ্ট হতেন। এর থেকে বাদ যেতেন না সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রী থেকে শুরু করে রাজকর্মকর্তাদের স্ত্রীরাও। আর নিয়মিত পতিতা তো ছিলই।

ভবিষ্যদ্বাণী[সম্পাদনা]

রাসপুতিনের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ছিল বলে বিশ্বাস করতেন সে সময়ের অনেকেই। এমনকি নিজের মৃত্যু বিষয়েও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মৃত্যুর আগে রাসপুতিন জার নিকোলাসের কাছে এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। তিনি বলেছিলেন, “যদি আমি সাধারণ জনগনের হাতে মারা যাই, তুমি, রাশিয়ার জার, তোমার সন্তানদের জন্য কোনো চিন্তা কর না, তারা আরও শত শত বছর রাশিয়া শাসন করবে। আর যদি আমার মৃত্যুর কারণ হয় তোমার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ, তাহলে শুনে রাখ, তোমার পরিবারের সবাই আগামী দুই বছরের মধ্যে খুন হবে, খুন হবে রাশিয়ার জনগণের হাতে।”

রোমানভ পরিবারের সদস্যের হাতে রাসপুতিনের খুন হওয়ার তিন মাস পর ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জার নিকোলাস দ্বিতীয় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হোন এক বিপ্লবের মাধ্যমে। ইতিহাসখ্যাত রুশ বিপ্লব নামেই যা পরিচিত। এরও দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নিকোলাসের পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিলেন। এর মধ্যেই রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান হয়।

প্রতিশোধের শিকার[সম্পাদনা]

রাসপুতিনের উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের জন্য অনেক শত্রু হয় তার বিরুদ্ধে। প্রিন্স ফেলিক্স ইউসুপভ এমন একজন। গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি প্যাভলোভিচ ছিলেন আরেকজন শত্রু। তিনি জার দ্বিতীয় নিকোলাসের চাচাতো ভাই। রাসপুতিনকে খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। রাসপুতিনের আরেক শত্রু হচ্ছেন ভ্লাদিমির পুরিশকেভিচ। তিনি ছিলেন রাশিয়ান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার একজন স্পষ্টবাদী সদস্য।

১৯১৬ সালের ১৯ নভেম্বর পুরিশকেভিচ ডুমায় এক ক্ষুব্ধ বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, জারের মন্ত্রীরা রূপান্তরিত হয়েছেন পুতুল নাচের পুতুলে। আর এই পুতুলগুলোর সুতা রয়েছে রাসপুতিন ও সম্রাজ্ঞী আলেক্সান্দ্রা ফিয়োদরোভনার হাতে। ফেলিক্স ইউসুপভ পার্লামেন্টে বসে তার এই বক্তব্য শোনেন এবং পুরিশকেভিচের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাসপুতিনকে খুন করার উদ্যোগ নেন। পরিকল্পনাটি ছিল খুব সহজ। ফেলিক্স ইউসুপভ রাসপুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তাকে হত্যার জন্য প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসবে ইউসুপভের প্রাসাদে। তারপর তাকে খুন করা হবে।

রাসপুতিন যৌনতা পছন্দ করেন। তার এই দুর্ববলতাকে ব্যবহার করা হবে তাকে খুন করতে। এ ক্ষেত্রে ফেলিক্স তার সুন্দরী স্ত্রী ইরিনাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি হন। ইরিনা এ কাজে রাজি না হলে ইরিনার মিথ্যা উপস্থিতির কথা বলে তাকে রাসপুতিনের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুনের এক মাস আগে নভেম্বরের দিকে ফেলিক্স যোগাযোগ করেন রাসপুতিনের সঙ্গে। বুকের ব্যথায় ভুগছেন এই বাহানায় রাসপুতিনের কাছে যান। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর একদিন আসে রাসপুতিনকে হত্যা করার মোক্ষম সুযোগ। ঘটনার দিন যখন রাসপুতিন ইরিনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন ফেলিক্স রাসপুতিনকে পেস্ট্রি খেতে বলেন। যা ছিল বিষাক্ত সায়ানাইড মিশ্রিত। রাসপুতিন খেতে অস্বীকৃতি জানান। ফেলিক্স চিন্তায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর রাসপুতিনের মন কিছুটা পরিবর্তন হয়। তিনি সামান্য পেস্ট্রি খেতে রাজি হন। কিন্তু পেস্ট্রি খাওয়ার পরও কোনো প্রকার পরিবর্তন হচ্ছিল না রাসপুতিনের। তখন তারা মদ খেতে শুরু করেন। মদেও বিষ মিশানো হয়েছিল। কিন্তু এতেও কোনো প্রকার পরিবর্তন হচ্ছিল না। মনে করা হয়েছিল সায়োনাইডের বিষক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটছিল না।

ফেলিক্স অপেক্ষা করতে করতেই এক পর্যায়ে ফেলিক্স গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি প্যাভলোভিচের কাছ থেকে একটি পিস্তল নিয়ে আসেন। পিস্তল তাক করে রাসপুতিনকে বললেন, ‘গ্রেগরি এফিমোভিচ, আপনি বরং যিশুখ্রিস্টের ক্রুশের মডেলটির দিকে তাকান এবং প্রার্থনা করুন।’ ফেলিক্স গুলি করেন। নিথর হয়ে পড়ে যান রাসপুতিন। এক ঘণ্টা পর ফেলিক্স লাশটি ধরে নাড়া দিলে কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। তবে লক্ষ্য করেন, রাসপুতিনের বাম চোখটা খোলার জন্য স্পন্দিত হচ্ছে। তিনি তখনো বেঁচে ছিলেন। এমন সময় রাসপুতিন হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ফেলিক্সের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার কাঁধ ও ঘাড় জড়িয়ে ধরেন। ফেলিক্স আতঙ্কিত অবস্থায় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চিত্কার করে বলতে থাকেন, ‘সে এখনো বেঁচে আছে’। পুরিশকেভিচ ওপরতলায়ই ছিলেন। তিনি ফেলিক্সের চিত্কার শুনতে শুনতে নিচে নেমে আসেন। ফেলিক্স ভয়ে তখন কাঁপছেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে, চোখ কুঠরি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। এরই মধ্যে রাসপুতিন দেয়ালঘেরা আবাসস্থল পেরিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকেন। পুরিশকেভিচ তার পিছে পিছে ছুটতে শুরু করেন।

তিনি রাসপুতিনকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল কিছু গুলি তারপর হঠাৎ ঠিকই গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছিল। গুলি রাসপুতিনের পিঠে আঘাত করে। রাসপুতিন থেমে গেলে পুরিশকেভিচ আবার গুলি চালান। এবার গুলি লাগে রাসপুতিনের মাথায়। মাটিতে পড়ে যান রাসপুতিন। তারপরেও মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন আর হামাগুড়ি দিয়ে চলছিলেন রাসপুতিন। কিন্তু পুরিশকেভিচ তাকে ধরে মাথায় লাথি মারতে থাকেন। উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকেন তিনি। কিছু পুলিশ সদস্য ঘটনা স্থলের কাছাকাছি ডিউটিতে ছিলেন তারা গুলির আওয়াজ পেয়ে বিষয়টি দেখার জন্য এগিয়ে আসেন। তারা প্রিন্স ইউসুপভ ও তার চাকর বুজিনিস্কির কাছে গুলির আওয়াজ সম্পর্ক জানতে চাইলে বুজিনিস্কি জানায় তারা কোনো আওয়াজ শোনেননি।

পরবর্তীতে রাসপুতিনের লাশ ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছিল। রাসপুতিনের বিকৃত হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে ফেলিক্স ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি ২ পাউন্ড ওজনের একটি ডাম্বেল হাতে নিয়ে এটি দিয়ে রাসপুতিনের দেহে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। ফেলিক্সকে যখন থামানো হলো তার দেহ ততক্ষণে রক্তরঞ্জিত হয়ে পড়েছে। ফেলিক্সের চাকর বুজিনিস্কি তখন পুরিশকেভিচকে পুলিশের সঙ্গে তার কথা হওয়ার বিষয়টি জানায়।

এটি বিস্ময়কর যে এত কিছুর পরও রাসপুতিন কিন্তু মারা যাননি। তিনি আসলেই হয়তো রহস্য পুরুষ! কারণ মাথায় বুকে গুলির পরও তিনি বেঁচে ছিলেন। এরপর তার দেহের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালানো হয়। অবশেষে ফেলিক্স ও পুরিশকেভিচ ক্লান্ত হয়ে রাসপুতিনের লাশ বরফ ঢাকা নদীর বরফ কেটে তার ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।

করুণ মৃত্যু[সম্পাদনা]

১৯১৬ সালে রাশিয়ার প্রভাবশালী সন্ন্যাসী রাসপুতিনকে বরফের নিচে পানিতে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পানিতে ডুবে তার মৃত্যুকে একটি নিছক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু ঘটনা তা নয়। রাসপুতিনের মৃত্যু যে একটি পরিকল্পিত হত্যা সেটি পরবর্তীতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। রাসপুতিনের দেহ নদীতে জমাট বরফ কেটে গর্ত করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে তার শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এমনকি অস্ত্রোপচার করে তাকে পুরুষত্বহীনও করা হয়েছিল। আসলে বহু নারীতে আসক্ত রাসপুতিনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল তার খুনিরা। তা ছাড়া তার মাথায়, ফুসফুস ও কলিজাতে উপর্যুপরি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন পদ্ধতি, অতিরিক্ত মাত্রায় এলকোহল সেবন, নারীদের প্রতি আসক্তি প্রভৃতি নানা কারণে রাসপুতিনের প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল অনেকের মনে। যার ফলেই এক করুণ মৃত্যু ঘটে এই সন্ন্যাস পুরুষ রাসপুতিনের। প্রতিশোধ নিতেই রাসপুতিনকে ১৯১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর সেন্ট পিটার্সবার্গে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে প্রথমে রাসপুতিনকে সায়ানাইড মিশ্রিত মদ আর কেক খাওয়ানো হয়, কিন্তু রাসপুতিন মারা যায়নি। এরপর ফেলিক্স রাসপুতিনের বুকে গুলি করেন। এরপরও রাসপুতিন মারা যাননি। এমনকি রাসপুতিন এরপরও পালিয়ে যেতে উদ্ধুত হলে আরও দুবার গুলি করে রাসপুতিনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তখনো রাসপুতিন মারা যায়নি। আহত রাসপুতিনের ওপর নানাবিধ অত্যাচার করা হয়। পরে বরফ ঢাকা নেভা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। যার কিছুদিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু তার মৃত্যু কিন্তু বিষক্রিয়ায় ঘটেনি। কারণ নিজের দেহকে সব প্রকার বিষক্রিয়ার প্রভাবমুক্ত করতে অনেক আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন রাসপুতিন। প্রতিদিন নির্দিষ্টমাত্রার বিষ নিজের দেহে প্রবেশ করাতেন তিনি। এতে তার দেহে বিষের এন্টিবডি তৈরি হয়েছিল। তার মৃত্যু হয়েছিল বরফ শীতল নদীর পানির কারণে। তীব্র শীতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]