রহিমুন্নিসা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রহিমুন্নিসা
পেশাকবি
পরিচিতির কারণসাহিত্যিক

রহিমুন্নিসা (১৭৬৩-১৮০০) অন্ত্যমধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একজন কবি।[১] তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম নারী কবি বলা হয়ে থাকে।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

রহিমুন্নিসা মুঘল শাসনামলে চট্টগ্রাম জেলার শুলকবহরে জন্মগ্রহণ করেন। তারা চার ভাইবোন ছিলেন। তার পিতার নাম আবদুল কাদির শাহ। তার পূর্ব পুরুষরা পবিত্র মক্কা থেকে মুংগের ও পরে চট্টগ্রামে এসেছিলেন।[১] অনুমান করা হয় ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ এর মধ্যে তাঁর জন্ম।

বাল্যকালে রহিমুন্নিসার বাবা মারা যান। এরপর তিনি তার মায়ের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্জন করেন। মাতার নাম আলিমন্নিসা। তার ছোট ভাই আবদুল গাফফার একজন আলেম ছিলেন। ভাইয়ের কাছেও তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।[১] পরে আবুল হুসেন নামে এক পন্ডিতের কাছে শিক্ষালাভ করে তিনি কাব্য রচনা করেন।[২] ১৮৬০ সালে হাটহাজারী উপজেলার জান আলী চৌধুরীর প্রথম পুত্র আহমদ আলী চৌধুরীর সাথে রহিমুন্নিসার বিবাহ হয়। তিনি সামেয়ান খাতুন ও দোরদানা খাতুন নামে দু'কন্যা এবং সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী নামে একপুত্র জন্ম দিয়েছেন।[৩]

রচনাকর্ম[সম্পাদনা]

মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষায় তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তার রচিত লাইলী মজনু কাব্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে তার অন্য কোনো লেখা পাওয়া যায়নি।[১] ১৯৫৫ সালে এনামুল হক যখন চট্টগ্রাম কলেজে কর্মরত ছিলেন, তখন একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকের কাছে তিনি এই পান্ডুলিপি পান। শুরুতে পান্ডুলিপিটি মধ্যযুগীয় কবি আলাউলের-এর পদ্মাবতী কাব্য ভাবা হলেও, পরে দেখা যায় যে তা রহিমুন্নিসা নামের এক নারীর অনুলিখিত পুঁথি। পুঁথির শেষে তিনি তার নিজের জীবনেকথার কাব্যিক বর্ণনা করেছেন।


পদ্মের ছন্দে সেখানে তিনি লিখেছেনঃ

“শুন গুণি গণ, হই এক মন,

লেখিকার নিবেদন।

অক্ষর পড়িলে, টুটাপদ হৈলে,

শুদরিঅ সর্বজন ।

পদ এই রাষ্ট, হেন মহা কষ্ট,

পুথি সতী পদ্মাবতী ।

আলাওল মণি, বুদ্ধি বলে গুণী,

বিরচিল এ ভারতী ।

পদের উকতি, বুঝি কি শকতি,

মুই হীন তিরী জাতি ।

স্বামীর আদেশ, মানিয়া বিশেষ,

সাহস করিলু গাথি…”


পান্ডুলিপির শেষে তিনি কাব্যের ছন্দে তিনি বলে গেছেন আত্মজৈবনিক বর্ণনা। স্বামীর প্রশংসায় কবি লিখেছেন:


গুণীদের পদ, করিএ ভকত,

কর মোরে আশীর্বাদ

স্বামীর সঙ্গতি, থাকিতে পিরীতি,

না হৌক যে বিসংবাদ।।

প্রভু করতারে, মুই অভাগীরে

করুনা রহে সতত

আন ভাব মতি, নৌক আন পত,

না করৌক লজ্জাগত।। ”


নিজের বংশ-পরিচয়ের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন যে তিনি কুরেইশ বংশের উত্তরসূরি:


“পীর হই রহে চট্টগ্রামেতে আসিআ ।।

সেক কোরসের বংশে জনম হইআ ।

বহু সিস্ব করিলেক এথাতে রহিআ ।।

তাহান মুরব্বীগণ দুক্ষিত হইআ ।

মক্কা দেশ হন্তে এথা রহিল আসিয়া ।।

সুকে যদি কথ দিন কাটিলেক কাল ।

দান ধর্ম পুণ্য কর্ম করিল বিসাল।।

জম হন্তে বলবন্ত কারে না দেখিআ।

স্বোর্গ পুরে জাই দেহ রহিলেক গিআ ।।

মুই হত অভাগিনী দেখ বোদ লোক।

বুদ্ধি স্হিত না হইতে পিতা পরলোক।।”


তার কাব্যের আমরা জানতে পারি যে নবাব সিরাজৌদ্দল্লাহ্রর পলাশীর যুদ্ধের হারের পর, ব্রিটিশদের অত্যাচারে তার পরিবার বিহারের মুঙ্গের থেকে চট্টগ্রামে আসেন:


“নাম গোত্র বিরচিয়া করিমু বর্ণন ।

কর্ণগতে শুন মন দিয়া কবিগণ ।।

জংলী শাহা নাম করি গুণে অনুপাম ।

আহালে কোরেশ বংশে উৎপত্তি তাহান ।।

যখনে ইমাম-সঙ্গে দাসীর নন্দন ।

ধর্ম ছাড়ি সজ্জ হৈল করিবারে রণ ।।

হোচেনের সেনাপতি মিলি কত লোক ।

ঈশ্বর স্মরিয়া মনে জানি কর্ম ভোগ ।।

কত কত বহিত্র যে পূর্ণ সাজ করি ।

বাগদাদে আসিলা ইমাম আজ্ঞা ধরি ।।

তথা হস্তে আর কত মুঙ্গেরে আসিল ।

সে মুলুক নৃপ সঙ্গে বহুযুদ্ধ হৈল ।।

অগ্রগামী হইয়া ইংরাজে যুদ্ধ দিল ।

দৈবদশা ফিরিঙ্গীর বিজয় হইল ।।

মুখ্য মুখ্য সবের বহুল রতœ ধন ।

লুটিয়া করিল খয় যত পাপিগণ ।।

অনেক লাঘবে নিজ জম্মভূমি ছাড়ি ।

চট্টগ্রামে আসিয়া রহিলা বাস করি ।।

পির হই শিষ্য কৈলা কত কত গ্রাম ।

প্রকাশ হইল তান যশ কৃতি নাম ।।”


কবির রচনায় 'পূর্ব-জন্মের' প্রসংগ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে তিনি অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে হিন্দু ধর্ম থেকেও ভাবধারা এনেছিলেন:


পূর্ব জম্মে কৈলু পাপ, সে দোষে ফলিল তাপ,

আশাভ্রষ্ট হৈলুম অনাথ।”


কন্যা দোরদানার মৃত্যু শোকে বিলাপ করে কবি রহিমুন্নিসা রচনা করেন পদ্য:


“মোর কন্যা তোর হস্তে শহীদ হইল।।

আপনার তিরী বলি না কৈলা বিচার।

কি উত্তর দিবি যাই গোচরে আল্লার।।

স্বর্গবাসী হুর সব হরষিত হৈয়া ।

কন্যা মোর নিল আসি আগু বাড়াইয়া।।

পিতায়ে কান্দন করে আর্তনাদ ছাড়ি।

কোথা লুকাইল মোর দোরদানা সুন্দরী…”


রহিমুন্নেসার জীবনের গল্পে জানা যায় এ যুগের গ্রামবাংলার নারীর সুখ-দুঃখ-কষ্টের অমূল্য গাঁথা।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলাপিডিয়া
  2. সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড) সাহিত্য সংসদ। পৃঃ ৪৬৪
  3. "হাটহাজারীর রত্ন মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবি রহিমুন্নিসার জীবনী"। ২৭ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৬ 

বহি:সংযোগ[সম্পাদনা]