ভুবন চিল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভুবন চিল
ভুবন চিল,
Milvus migrans
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণীজগৎ
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Falconiformes
(or Accipitriformes, q.v.)
পরিবার: Accipitridae
গণ: Milvus
প্রজাতি: M. migrans
দ্বিপদী নাম
Milvus migrans
(বোডায়ের্ট, ১৭৮৩)
উপপ্রজাতি

৫টি, নিবন্ধ দেখুন

ভুবন চিল ও হলদেঠুঁটি চিলের বিস্তৃতি
     সারাবছর অবস্থান
     গ্রীষ্মকালীন অবস্থান
     শীতকালীন পরিযায়ী
প্রতিশব্দ
  • Falco migrans Boddaert, 1783
  • Milvus affinis
  • Milvus ater
  • Milvus melanotis

ভুবন চিল, বাদামি চিল, গোদা চিল, ডোম চিল (বৈজ্ঞানিক নাম: Milvus migrans) (ইংরেজি: Black Kite) বা কেবলই চিল Accipitridae (অ্যাক্সিপিট্রিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Milvus (মিলভাস) গণের এক প্রজাতির মাঝারি আকারের সুলভ শিকারী পাখি[১][২] ভুবন চিলের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ পরিযায়ী চিল (গ্রিক Milvus = চিল, migrans = পরিযায়ন)।[২] সাঁওতালি ভাষায় ভুবন চিলের নাম কুরিত, সিংহলিতে রাজালিয়া, অসমিয়ায় চিলানামুগাচারানি; সিন্ধিতে নাম সিরিউন[৩]

দুই মেরু আর দুই আমেরিকা মহাদেশ বাদে প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়ে এদের বিস্তৃতি।[৪] এরা বিগত কয়েক বছরে কি হারে কমছে বা বাড়ছে সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে এরা সন্তোষজনক সংখ্যায় রয়েছে। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।[৫] পৃথিবীতে মোট ভুবন চিলের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লক্ষ থেকে ৬০ লক্ষটি বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখ করেছে।[৪] বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[২]

শ্রেণিবিন্যাস ও উপপ্রজাতি[সম্পাদনা]

অ্যাক্সিপিট্রিডি (Accipitridae) গোত্রের অন্তর্গত MilvusHaliaeetus (সিন্ধুঈগল) গণদ্বয়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মিল রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গণ দুইটি একটি উপগোত্রের অন্তর্গত।[৬] Milvus গণের আরেকটি প্রজাতি লাল চিলের (Milvus milvus) সাথে ভুবন চিলের বেশ মিল রয়েছে। বন্দী অবস্থায় এবং বন্য পরিবেশে এই দুই প্রজাতির সংমিশ্রণে সঙ্কর ছানা জন্ম দেয়ারও নজির রয়েছে।[৭]

উপপ্রজাতি[সম্পাদনা]

ভুবন চিলের প্রকৃতপক্ষে মোট কতটি উপপ্রজাতি রয়েছে তা একটি [[বিতর্ক|বিতর্কের বিষয়। পূর্বে ভুবন চিলের মোট সাতটি উপপ্রজাতি ছিল। aegyptiusparasitus উপপ্রজাতি দু'টো নিয়ে নতুন একটি প্রজাতি হলদে-ঠুঁটি চিলের উদ্ভব হয়েছে। অনেকে অবশ্য এই নতুন প্রজাতিকরণ সমর্থন করেন না।[৮] উপপ্রজাতি দু'টিকে ভুবন চিলেরই উপপ্রজাতিরূপে গণ্য করেন। aegyptius-এর আবাস মিশর, আরব উপদ্বীপের পশ্চিমাংশ এবং কেনিয়া পর্যন্ত পূর্ব উপকূলীয় আফ্রিকা জুড়ে এদের বিস্তৃতি সীমাবদ্ধ। আর parasitus উপপ্রজাতির প্রধান আবাস দক্ষিণ সাহারা, কেপ ভার্দ দ্বীপপুঞ্জ, কমোরোস দ্বীপপুঞ্জমাদাগাস্কার। অন্য পাঁচটি উপপ্রজাতিগুলো হল[৯]:

  • M. m. migrans (Boddaert, 1783) - উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া (তিয়েনশান পর্বতমালা) হয়ে দক্ষিণে পাকিস্তান পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। শীতকালে সাহারার দক্ষিণে ও আফ্রিকার দক্ষিণে পরিযায়ী হয়। উপপ্রজাতিটির মাথা সাদাটে। ঠোঁটের গোড়ায় হলুদ পট্টি থাকে।
  • M. m. lineatus (J. E. Gray, 1831) - সাইবেরিয়ার একদম পূর্বাঞ্চল, মাঞ্চুরিয়া, জাপান থেকে উত্তর ভারত, উত্তর মায়ানমার এবং চীনের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এদের বিস্তৃতি। শীতকালে এদের দক্ষিণ ইরাক, দক্ষিণ ভারত, বাংলাদেশদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিযায়ন করতে দেখা যায়। ইংরেজিতে উপপ্রজাতিটির নাম Black-eared Kite; কারণ এর কানে একটি কালো পট্টি থাকে। সকল উপপ্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের। পেটের দিক এবং ডানার বন্ধনী-পালক স্পষ্ট খাড়া রেখাযুক্ত। পেটের নিম্নাঞ্চল, অবসারণী-ঢাকনি ও লেজের নিচের ঢাকনি-পালক ফিকে বাদামি। প্রাথমিক পালকের গোড়ার সাদাটে রঙ অন্যান্য উপপ্রজাতির তুলনায় বেশি প্রশস্ত। লেজের চেরা কম। ডানার বাইরের অংশ বেশি প্রশস্ত এবং মাঝ বরাবর থেকে নিচের দিকে বাঁকানো। চোখ কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেহে রেখার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে।[১]
  • M. m. formosanus (Nagamichi Kuroda, 1920) - দক্ষিণ চীনের হাইনান দ্বীপতাইওয়ান এদের প্রধান আবাস। স্থানিক স্বভাবের।
  • M. m. govinda (Sykes, 1832) - বাংলাদেশ, পূর্ব ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোচীনমালয় উপদ্বীপ এদের প্রধান আবাস। অন্যসব উপপ্রজাতির তুলনায় গাঢ়তর। আকারে তুলনামূলক ছোট ও বেশি হাল্কা পাতলা দেখায়। গায়ে রেখার পরিমাণ কম। অধিক চেরা লেজ থেকে খুব সহজেই এদের আলাদা করা যায়। মাথায় রেখার পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু মাথা ও শরীরের রঙ একই রকম, ফলে মাথার রেখাসমূহ নজরে পড়ে না। চোখ হলদে এবং মণিবন্ধে সাদা এলাকার পরিমাণ খুব কম।[১]
  • M. m. affinis (Gould, 1838) - ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি ও সুন্দা দ্বীপ, পাপুয়া নিউগিনি ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া জুড়ে এদের বিস্তৃতি।

বর্ণনা[সম্পাদনা]

লেজের গঠনে বিভিন্নতা: ভুবন চিল (বামে) ও লাল চিল (ডানে)
ভুবন চিলের কঙ্কাল, জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর, ওয়াশিংটন ডি. সি., যুক্তরাষ্ট্র

ভুবন চিল লম্বা চেরা লেজওয়ালা কালচে-বাদামি মাঝারি আকারের শিকারী পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬১ সেন্টিমিটার, ডানা ৪৩.৮ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৩.৬ সেন্টিমিটার, পা ৫.২ সেন্টিমিটার ও লেজ ২৬.৫ সেন্টিমিটার।[২] পুরুষ চিলের ওজন ৬৩০-৯৩০ গ্রাম এবং স্ত্রী পাখির ওজন ৭৫০-৯৪০ গ্রাম।[১০] স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। তবে স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখির তুলনায় একটু বড় হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ স্পষ্ট গাঢ় লালচে-বাদামি। পিঠ কালচে লাল-বাদামি। ডানার উপরের অংশের মধ্য-ঢাকনি বরাবর ফিকে বাদামি রঙের ফিতা থাকে। ওড়ার সময় এর ডানার নিচের সাদা প্রাথমিক পালকগুলো স্পষ্ট নজরে পড়ে। ঠোঁট স্লেট-কালো। চোখ বাদামি; এবং পা ও পায়ের পাতা ফিকে হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও পেটে প্রশস্ত সাদাটে কিংবা পীতাভ ডোরা থাকে। গায়ে অনিয়মিত ফিকে তিলা দেখা যায়। তখন দূর থেকে এদের হালকা বাদামি দেখায়। উপপ্রজাতিভেদে ভুবন চিলের চেহারায় বিভিন্নতা দেখা যায়।[২]

স্বভাব[সম্পাদনা]

বিচরণস্থল ও আবাস[সম্পাদনা]

খোলা বিস্তীর্ন এলাকা ভুবন চিলের প্রিয় এলাকা। এছাড়া ঘন বন, পাতলা বন, পার্বত্য অঞ্চল, নদীর পাড়, বেলাভূমি, বন প্রান্ত, ঘাসবন, সাভানা প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়। এছাড়া বড় বড় বন্দর, শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলেও দেখা যায়। govinda উপপ্রজাতিটি নগর এলাকায় বেশি দেখা যায়। lineatus উপপ্রজাতি আর্দ্র ও জনহীন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।[৮] বড় বড় গাছে এরা দলবদ্ধভাবে রাত কাটায়। ভোরে সূর্য উঠলে এরা দল বেঁধে আকাশে ওড়ে আর অনেক্ষণ ঝাঁক বেঁধে চক্রাকারে উড়ে বেড়ায়। তারপর খাদ্যের সন্ধানে বিভক্ত হয়ে যায়। সন্ধ্যা বেলায় এরা তাদের আবাসে ফিরে আসে এবং পুনরায় ভোর বেলার মত চক্রাকারে কিছুক্ষণ ওড়ে। তারপর গাছে এসে বসে পড়ে।

শীতে বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী ভুবন চিল এসে বাংলাদেশে আবাসিক পাখির দলে যোগ দেয়।[২]

খাদ্যাভাস[সম্পাদনা]

ভুবন চিল সুযোগসন্ধানী খাদক। এর খাদ্যতালিকা বেশ বিশাল। এর খাদ্যতালিকা স্থানীয় খাদ্যের যোগানের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পানির আশেপাশে আবাস হলে মাছই এদের প্রধান শিকার হয়। অনেকসময় এরা মৃত বা রুগ্ন মাছও খায়। আহত, মৃত বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি, স্তন্যপায়ী, ব্যাঙ, সরিসৃপ ও পোকামাকড়ও খায়। অন্য ভুবন চিল, পাখি বা প্রাণীর কাছ থেকে এরা খাবার ছিনিয়ে খায়।[১০] গ্রামে হাঁস-মুরগির ছানা ছিনতাই করতে এরা ওস্তাদ। বর্জ্যভূক পাখি হিসেবে কসাইখানা, বর্জ্য-স্তুপ, ময়লাপোঁতা, মাছবাজার ও পোতাশ্রয়ে ওরা উচ্ছিষ্ট ও বর্জ্য খায়। প্রায়ই শকুনের সাথে মিলে উচ্ছিষ্ট বা পশুর মৃতদেহ খায়।[২]

খাদ্যের সন্ধানে এরা আকাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস ভঙ্গিমায় চক্কর কেটে বেড়ায়। এরা খুব কমই ডানা ঝাপটায়। ডানার তুলনায় শরীর হালকা হওয়ায় এরা অনেক্ষণ ডানা না ঝাপটে ভেসে বেড়াতে পারে। নৌকার হালের মতো লেজ ব্যবহার করে ঝটপট দিক বদল করতে পারে। উড়তে পারে বাতাসের প্রতিকূলেও। খাদ্যের সন্ধান পেলে এরা ডানা গুটিয়ে ফেলে ও ঝাঁপ দিয়ে শিকার ধরে।[৮]

ডাক[সম্পাদনা]

ভুবন চিল দীর্ঘ কাঁপা কাঁপা সুরে শিস দিয়ে ডাকে: কিউইইইইইইই-উয়ি-উয়ি-উয়ি-উই-উ.....

প্রজনন[সম্পাদনা]

মার্চ থেকে মে ভুবন চিলের প্রধান প্রজনন ঋতু। এ সময় পুরুষ চিল আকাশে চক্রাকারে উড়তে থাকে এবং হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে ডালে বসে থাকা স্ত্রী চিলের পিঠে এসে নামে। স্থানভেদে প্রজনন মৌসুমে বিভিন্নতা দেখা যায়। উঁচু গাছে কাঠি, ডালপালা ও কাঠি দিয়ে এলোমেলো মাচার মত বাসা বানায়। উঁচু দালানে পানির ট্যাঙ্কেও বাসা করতে পারে।[১] বাসায় নষ্ট কাগজ, পাখির পালক, ছেঁড়া কাপড়, শুকনো গোবর, কাদা, উজ্জ্বল প্লাস্টিকের বস্তুও থাকে। বাসার উচ্চতা ভূমি থেকে ৫ মিটার থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত হয়। বাসা বানানো হয়ে গেলে ২-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ পাটল-সাদা। ডিমের মাপ ৫.৩ × ৪.৩ সেন্টিমিটার।[২] ৩০ থেকে ৩৪ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানারা প্রায় দুই মাস বাসায় থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় চিলই বাসা বানায়, ডিমে তা দেয় ও সন্তান লালন-পালনের ভার নেয়। দুই বছর বয়সে ছানারা প্রজননক্ষম হয়।

গ্যালারি[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ১৮৯-৯০।
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ২৩৩।
  3. বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয়প্রার্থী চিলেরা[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], দৈনিক কালের কণ্ঠ।
  4. Milvus migrans ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে, BirdLife International এ ভুবন চিল বিষয়ক পাতা।
  5. Milvus migrans ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে, The IUCN Red List of Threatened Species এ ভুবন চিল বিষয়ক পাতা।
  6. Orta, J., "Black Kite", in del Hoyo, J., A. Elliott, and J. Sargatal (eds). Handbook of birds of the world. Vol. 2. New World vultures to guineafowl, (Barcelona: Lynx Edicions, 1994), pp. 118-119.
  7. Whistler, Hugh (১৯৪৯)। Popular handbook of Indian birds (4 সংস্করণ)। Gurney and Jackson, London। পৃষ্ঠা 371–373। আইএসবিএন 1-4067-4576-6 
  8. Black Kite ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে, The Peregrine Fund: Global Raptor Information Network.
  9. Black Kite ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে, The Internet Bird Collection এ ভুবন চিল বিষয়ক পাতা।
  10. Black Kite ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ মে ২০১২ তারিখে, Europian Raptors Biology and Conservation.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]