ভারতে জুনাগড়ের অন্তর্ভুক্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভারতে জুনাগড়ের অন্তর্ভুক্তি বলতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই নভেম্বর দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এই ঘটনার ফলে জুনাগড় রাজ্যে বাবি রাজবংশের নবাবের শাসনের অবসান ঘটে।

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ ভারতকে বিভক্ত করে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা করার পর, ঐ বছর ১৮ই জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ পাশ হয়। এই আইনের ফলে ভারতপাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্রের জন্মের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি দেশীয় রাজ্যগুলিকে এই দুই রাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা স্বাধীন থাকার মধ্যে একটি পথ বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়।[১]

পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিপত্র[সম্পাদনা]

জুনাগড় রাজ্যের অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পক্ষ থেকে তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ভপ্পলা পঙ্গুন্নি মেনন জুনাগড় রাজ্যের নবাব তৃতীয় মহম্মদ মহবত খানজীকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট দস্তুরুল অমল সরকার জুনাগড় নামক সরকারি গেজেটে নবাব পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।[২] এই ঘোষণার পরেই তিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। তার স্বাক্ষর করা অন্তর্ভুক্তি চুক্তি নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল করাচি পৌঁছলে পাকিস্তানের গণপরিষদ তার সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। ১৫ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। পাকিস্তানজুনাগড় রাজ্যের সরকারী গেজেটে এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার প্রতিবাদে রাজ্যের বাবারিয়াওয়াড়মাংরোল অঞ্চলের অধিবাসীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন, যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে জুনাগড় রাজ্যের সেনাবাহিনী প্রেরিত হয়।

মেননের সফর[সম্পাদনা]

স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রমন্ত্রকের সচিব ভপ্পলা পঙ্গুন্নি মেনন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর জুনাগড় পৌঁছে রাজ্যের দেওয়ান শাহ নওয়াজ ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মেনন নবাবের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করে ভারত সরকারের বার্তা দিতে চাইলে ভুট্টো তা সম্ভব নয় বলে জানান। অসন্তুষ্ট মেনন জুনাগড় রাজ্যের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ব্যাপারে জোর দিলে ভুট্টো পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা জানান।[৩]

আর্জী হুকুমত[সম্পাদনা]

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে সেপ্টেম্বর রাজকোট শহরে মহাত্মা গান্ধীর আত্মীয় সমলদাস গান্ধী নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে আর্জী হুকুমত নামক একটি অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারের পরবর্তীকালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই অস্থায়ী সরকারে তাদের কোন রকম ভূমিকার কথা অস্বীকার করলেও মনে করা হয় যে, মেনন গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করে এই পরিকল্পনার তৈরী করেন।[২][৩]

সেনা আক্রমণ[সম্পাদনা]

ভারত সরকারের তরফ থেকে কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে অবস্থিত সেনাবাহিনীকে জুনাগড়ের চারিদিকে কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৪ঠা অক্টোবর সেনাবাহিনীকে জুনাগড় রাজ্যের অন্তর্গত ভারতে যোগদানে ইচ্ছুক বাবারিয়াওয়াড়মাংরোল অঞ্চল অধিকারের কৌশল স্থির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রস্তুতি হিসেবে কাথিয়াওয়াড় ডিভিশন নামে একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করে ব্রিগেডিয়ার গুরদয়াল সিংহকে তার প্রধান করা হয়। পোরবন্দরে তিনটি যুদ্ধজাহাজ এবং রাজকোট বিমানবন্দরে আটটি টেম্পেস্ট বিমান প্রস্তুত রাখা হয়।[৪] ভারত সরকার জুনাগড়ের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে মাল পরিবহন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় নবাব তৃতীয় মহম্মদ মহবত খানজী ও তার পরিবার ২৫শে অক্টোবর জুনাগড় থেকে করাচি চলে যান। দেওয়ান শাহ নওয়াজ ভুট্টো ২৭শে অক্টোবর জিন্নাহকে রাজ্যের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ও ২৮শে অক্টোবর পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব ইকরামউল্লাহকে সাহায্যের অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। কিন্তু পাকিস্তানের তরফ থেকে কোন সাহায্য পাঠানো হয়নি।

১লা নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাবারিয়াওয়াড়মাংরোল অধিকার করে নেয়। এই দিন ভুট্টো ভারতের তরফ থেকে সশস্ত্র আক্রমণের কথা উল্লেখ করে নবাবকে টেলিগ্রাম করেন। এর প্রত্যুত্তরে নবাব তাকে জুনাগড়ের মুসলিম জনগণের স্বার্থরক্ষা করার সমস্ত কর্তৃত্ব প্রদান করে টেলিগ্রাম পাঠান। ৫ই নভেম্বর জুনাগড় রাজ্য পরিষদ একটি সভায় ভুট্টোকে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার কর্তৃত্ব প্রদান করে। ভুট্টো ক্যাপ্টেন হার্ভে জনসন নামক মন্ত্রী পরিষদের একজন বরিষ্ঠ সদস্যকে ভারতীয় আধিকারিকদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রাজকোট পাঠান।[২] ৭ই নভেম্বর জুনাগড় রাজ্য পরিষদের একটি সভায় স্থির হয় যে, ভারত সরকারকে জুনাগড় রাজ্যের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ করা হবে। সেই মতো ৮ই নভেম্বর, ভুট্টো জনসনকে রাজকোটে ভারত সরকারের প্রতিনিধি নীলম বুচের নিকট পাঠিয়ে জুনাগড়ে আইন শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য সহায়তার অনুরোধ করে করাচি চলে যান। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে একটি আদেশনামায় লিখিত হয়, যেখানে দেওয়ান ভুট্টোর অনুরোধে ভারত সরকার দ্বারা জুনাগড় অধিগ্রহণের ঘোষণা করা হয়। ৯ই নভেম্বর ভারতীয় সেনা সরদারগড় ও বন্তভা অধিকার করে নেয় এবং ভারতীয় আধিকারিকেরা জুনাগড় পৌঁছে রাজ্যের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Indian Independence Act 1947 (c.30)" (পিডিএফ)Original Statute from The UK Statute Law Database। Office of Public Sector Information, National Archives, UK। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৪-৩০ 
  2. Yājñika, Acyuta; Sheth, Suchitra (2005)। The Shaping of Modern Gujarat: Plurality, Hindutva, and Beyond। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 328। আইএসবিএন 9780144000388। সংগ্রহের তারিখ ২৬শে জানুয়ারি, ২০১৫  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  3. Sandeep Bhardwaj (আগস্ট ২৮, ২০১৩)। "Accession of Junagadh: Farce of History"www.revisitingindia.com। www.revisitingindia.com। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ 
  4. Syed Ali Mujtaba (৩১ জানুয়ারি ২০১১)। "The Story Of The Accession Of The Princely State Of Junagarh"www.countercurrents.org। www.countercurrents.org। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ 

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Hodson, Henry Vincent. The Great Divide: Britain-India-Pakistan. New York: Atheneum, 1971
  • Menon, Vapal Pangunni. Integration of the Indian states. Orient Longman, 1985
  • Raghavan, Srinath. War and peace in Modern India. Palgrave Macmillan, 2010.