বেলিজের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বেলিজের ইতিহাস হাজারো বছরের পুরনো। ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে মায়া সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে মায়া সভ্যতা ব্যাপক উন্নতি করে। কাহাল পেখ, কারাকোল, লামানাই, লুবানতুন, আলতুন হা, হুনানতুনিখ সহ বিভিন্ন জায়গায় মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ষোড়শ শতকে স্পেনীয় আধিপত্যবাদীরা (কনকুইস্তাদর) এখানে প্রবেশ করে, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ জলদস্যুরা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কখনো কখনো বেলিজ পরিদর্শন করেছে। ১৭১৬ সালে ব্রিটিশরা প্রথম এখানে বসতি স্থাপন করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বেলিজে ব্রিটিশ ও স্পেনের মধ্যে প্রায়ই সংঘাত সৃষ্টি হতো; আবার আফ্রিকান ক্রীতদাসরা এখানে ব্রিটিশ কৃষি ব্যবসায়ীদের জমিতে কাজ করার উদ্দেশ্যে আগমন করে।[১] ১৮৬২ সালে এর নাম হয় "ব্রিটিশ হন্ডুরাস উপনিবেশ।"১৮৭১ সালে উপনিবেশটি মহারানির শাসনের অধীন হয়। অতঃপর প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা সৃষ্টিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার একে একটি "আধা-সরকার"ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনুমতি দেয়। ১৯৭৩ সালের জুনে ব্রিটিশ হন্ডুরাসের নাম পাল্টিয়ে "বেলিজ" করা হয়। ১৯৮১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর দেশটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।[২]

মায়া সভ্যতা[সম্পাদনা]

ইয়ুকাতান উপদ্বীপের নিম্নভূমি ও দক্ষিণের উঁচুভূমিতে ত্রিশ লক্ষ বছর আগে মায়া সভ্যতার উৎপত্তি হয়। এ এলাকাটি বর্তমানে দক্ষিণপূর্ব মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, পশ্চিম হন্ডুরাস ও বেলিজের অংশ। পাঁচশ বছর ধরে এ অঞ্চলগুলোতে ইউরোপীয়রা আধিপত্য বিস্তার করলেও মায়া সংস্কৃতির প্রভাব এখনো সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। ২,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে খাদ্য অন্বেষণকারী জাতিগুলো কৃষিকাজ ও শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৫০ খ্রিস্টাব্দে মায়া সভ্যতার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি গড়ে ওঠে। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে মায়া সভ্যতার ধ্রুপদি যুগের সূচনা ঘটে। এসময় তারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়।[৩]

বেলিজীয় মায়া সভ্যতার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাসের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে কারাকোল। মায়া অভিজাতদের ভাষা চোলতিয়ানে লেখা অনেক শিলালিপি সেখানে পাওয়া গেছে।[৪] উত্তরে লামানাইয়ে ইয়ুকেতান ছিল ব্যবহার্য ভাষা।[৫]

কৃষকরা সেচভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা, "জ্বালাও ও পোড়াও" (Slash and Burn) সহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে কৃষিকাজ করতেন। তাদের উৎপাদিত খাদ্য ছিল মায়া সভ্যতার কারিগর, যোদ্ধা ও পুরোহিতদের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। মায়া সভ্যতায় পুরোহিতরা জটিল গাণিতিক পদ্ধতিতে সময়গণনার এক অনন্য কৌশল আবিষ্কার করেন।

মায়ানরা মৃৎশিল্প ও নির্মাণশিল্পে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করে। তাছাড়া পালক ব্যবহার করে নানা রকম সাজপোশাক তৈরিতেও সুনিপুণ ছিল।

মায়া সভ্যতার ধ্রুপদী যুগে বেলিজে চার থেকে দশ লক্ষ মানুষ বসবাস করত। কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত সকল এলাকাতেই তারা বসতি স্থাপন করেছিল। কিন্তু দশম শতাব্দীতে মায়া সভ্যতার দ্রুত পতন ঘটে। মায়ানদের পতনের পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায় না। ঐতিহাসিকদের ধারণা, অনেকগুলো জটিল ঘটনাপ্রবাহ মায়া সভ্যতাকে একসময় ধ্বংসের মুখে পতিত করে।[৩]

আদি ঔপনিবেশিক যুগ[সম্পাদনা]

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বেলিজে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের সময়ও অনেক মায়ান এখানে বসবাস করত। স্পেনীয়রা গুয়াতেমালা ও হন্ডুরাস দখল করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করে। ১৫২৭ সালে ইয়ুকাতান দখলের জন্য অভিযান শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্পেনীয় ধর্মযাজকরা মায়ানদের নিয়ন্ত্রণ ও ধর্মান্তরিত করার জন্য মিশনারি চার্চ প্রতিষ্ঠা করে।

বেলিজ উপকূলে জলদস্যুদের উপদ্রব ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৬৪২ ও ১৬৪৮ সালে জলদস্যুরা দক্ষিণ ইয়ুকাতানে অবস্থিত স্পেনীয় সরকারের সদর দপ্তর "সালামানকা দি বাকালার"-এ প্রচুর লুটপাট চালায়। ১৭২৯ সালে বাকালার শহরকে নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়।

১৬৩৮ থেকে ১৬৯৫ সালে তিপু অঞ্চলের মায়ানরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করলেও ১৬৯৬ সালে স্পেনীয়রা তিপু দখল করে এবং ১৭০৭ সালে পেতেন ইচজা অঞ্চলে তিপু অঞ্চলের অধিবাসীদের নির্বাসিত করে। ১৬৯৭ সালে তারা ইচজা দখল করে নেয়। অপরদিকে জুলুনিকব অঞ্চলে ব্রিটিশরা বসতি স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে ওঠে।

স্পেন ও ব্রিটেনের মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা[সম্পাদনা]

১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে স্পেন তার উপনিবেশগুলোর বাণিজ্যিক কার্যকলাপের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। কিন্তু অন্যান্য শক্তি দ্রুতই স্পেনীয় আধিপত্যের অবসান ঘটাতে তৎপর হয়ে ওঠে। এ কাজে তারা চোরাচালান,জলদস্যু হামলা পরিচালনা, যুদ্ধসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংরেজ জলদস্যুরা দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকো ও ইয়ুকাতান উপদ্বীপে কাপড় ডাই করার কাজে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের কাঠ (লগউড) কর্তন শুরু করে। প্রথম প্রথম তারা লগউড বহনকারী স্পেনীয় জাহাজগুলো লুটপাট করে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করত। তারপর ১৬৫০ ও ১৬৬০ সালে তারা নিজেরাই লগউড কাটতে শুরু করে। জলদস্যুদের উপদ্রব বন্ধের লক্ষ্যে ১৬৬৭ সালে স্পেনীয়রা অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে।

১৭১০ সালে কায়ো কোসিনায় ব্রিটিশরা প্রথম বসতি স্থাপন করে। ১৭১৭-১৭১৮ সালের শীতে কুখ্যাত জলদস্যু ব্ল্যাকবেয়ার্ড মেক্সিকোর ভেরা ক্রুজ বন্দর থেকে আগত জাহাজগুলোর উপর ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। [৬]

ব্রিটিশরা লগউড কর্তনের অধিকার নিয়ে স্পেনীয়দের সাথে একাধিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ১৭৬৩ সালে স্পেনীয়রা প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশদের এ অধিকার প্রদান করে। ১৭৭৯ সালে ফের তাদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে ব্রিটিশরা বসতি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৮৩ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি তাদের এ অধিকার ফিরিয়ে দেয়। তবে ঐ সময় লগউড ব্যবসার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে এবং হন্ডুরান মেহগনি প্রধান রপ্তানিদ্রব্যে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Restall, Matthew। Creating “Belize”: The Mapping and Naming History of a Liminal Locale (ইংরেজি ভাষায়)। 51 
  2. "Belize"U.S. Department of State। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-৩০ 
  3. "About this Collection | Country Studies | Digital Collections | Library of Congress"Library of Congress, Washington, D.C. 20540 USA। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-৩০ 
  4. Houston, Stephen; Robertson, John; Stuart, David (২০০০-০৬-০১)। "The Language of Classic Maya Inscriptions"Current Anthropology41 (3): 321–356। আইএসএসএন 0011-3204ডিওআই:10.1086/300142 
  5. "Research Reports on Ancient Maya Writing"www.mesoweb.com। ২০২১-০৩-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-৩০ 
  6. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০২০