বিভক্তির যুগ (তিব্বত)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বিভক্তির যুগ নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত তিব্বতের ইতিহাসের পর্যায়কালকে বলা হয়ে থাকে। এই সময় তিব্বত সাম্রাজ্যের অধীনে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার পতনের ফলে তিব্বত বিভক্ত হয়ে পড়ে।

তিব্বত সাম্রাজ্যের পতন[সম্পাদনা]

তিব্বতের অন্তিম সম্রাট খ্রি-উ-দুম-ব্ত্সান বা গ্লাং-দার-মাকে বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী সম্রাট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কথিত আছে, তিনি তিব্বত সাম্রাজ্যে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করেছিলেন।[১][২] পদ্মসম্ভবের পঁচিশজন শিষ্যের মধ্যে একজন ল্হা-লুং-দ্পাল-গ্যি-র্দো-র্জে বৌদ্ধ ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে গ্লাং-দার-মাকে হত্যা করেন। [৩] :৭১[৪]:১৬৮ গ্লাং-দার-মার মৃত্যুর পর দুই স্ত্রীর দুই পুত্র য়ুম-ব্র্তান (ওয়াইলি: yum brtan) এবং ওদ-স্রুং (ওয়াইলি: od srung) সাম্রাজ্যের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করলে তিব্বত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। য়ুম-ব্র্তান মধ্য তিব্বতের দ্বুস অঞ্চল এবং ওদ-স্রুং গুজ অঞ্চলে শাসন করেন।[৩]:৭১[৫]:১১৭

বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

এই গৃহযুদ্ধের ফলে তিব্বতী রাজতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পায়[৬]:৫৭ এবং তিব্বত অনেকগুলি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই রাজ্যগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় ১২৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিব্বতে কোন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না।[৫]:১১৭

লাদাখে বিস্তার[সম্পাদনা]

ওদ-স্রুংয়ের পুত্র দ্পাল-'খোর-ব্র্ত্সানের (ওয়াইলি: Dpal 'khor brtsan) ব্ক্রা-শিস-ব্র্ত্সেন-ব্র্ত্সান (ওয়াইলি: Bkra shis brtsen brtsan) এবং স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন (ওয়াইলি: Skyid lde nyima mgon) নামক দুই পুত্র ছিল। স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলের স্তোদ-ম্ঙ্গা-রিস অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] তিনি লাদাখকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং লাদাখি রাজবংশের সুত্রপাত করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্পাদিত লা-দ্ভাগ্স-র্গ্যাল-রাব্স বা লাদাখের রাজাদের ধারাবিবরণীতে বলা হয় যে রাজা স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন তার তিন পুত্রের মধ্য তার সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। এই বিবরণীতে বলা হয় তিনি তার তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র দ্পাল-গ্যি-ঙ্গোনকে মার‍্যুল বা লাদাখ, হ্গোগের স্বর্ন খনি, রু-থোগ বা রুদোক, ল্দে-ম্চোগ-দ্কার-পো বা দেমচোক ও রা-বা-দ্মার-পো প্রদান করেন।[n ১] স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোনের অপর পুত্র ব্ক্রা-শিস-ম্গোন (ওয়াইলি: bKra shis mgon) পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলে রাজত্ব করে গুজ এবং পু-হ্রাং নামক রাজ্য স্থাপন করেন।

বৌদ্ধ ধর্ম[সম্পাদনা]

বিভক্তির যুগে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের প্রগতি স্তব্ধ হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা, কারাবাস ও নির্বাসন দেওয়া হয়। এই সময় তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চল আমদোতেই একমাত্র অতিব্বতী গোষ্ঠীদের মধ্যে তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম টিকে থাকে। এই সময় দ্পাল-ছুব-বো-রি (ওয়াইলি: dpal chub bo ri) নামক স্থান থেকে দ্মার-বান-শাক্য-সেং-গে (ওয়াইলি: dmar ban shakya seng ge), গ্ত্সাং-রাব-গ্সাল (ওয়াইলি: gtsang rab gsal) এবং গ্যো-দ্গে-ছুং (ওয়াইলি: g.yo dge chung) নামক তিনজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বিনয় ও অভিধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ নিয়ে ম্ঙ্গা'-রিস, মঙ্গোলিয়া হয়ে আমদো পৌঁছন। এই অঞ্চলে তারা আন-ছুং-গ্নাম-র্দ্জোং (ওয়াইলি: an chung gnam rdzong) বৌদ্ধবিহারে বসবাস শুরু করেন। তাদের শিষ্য মু-জু-গ্সাল-'বার (ওয়াইলি: mu zu gsal 'bar) (৮৩২-৯১৫), যিনি পরবর্তীকালে ব্লা-ছেন-দ্গোংস-পা-রাব-গ্সাল (ওয়াইলি: bla chen dgongs pa rab gsal) নামে পরিচিত হন, উত্তর পূর্ব তিব্বত অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটান।[৯]

গুজ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ব্ক্রা-শিস-ম্গোনের পুত্র ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ (ওয়াইলি: Byang Chub Ye shes' Od) কাশ্মীরে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিব্বত থেকে একুশ জন শিক্ষার্থীকে পাঠান। তিনি ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে থোলিং বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন এবং ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানান। এর ফলে পশ্চিম তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার ঘটে। [১০]:৩৮৮, ৩৯৪

পরবর্তীকালে ব্লা-ছেন-দ্গোংস-পা-রাব-গ্সাল এবং অতীশ দীপঙ্কর দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত দশজন বৌদ্ধ মধ্য তিব্বত অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। ১০৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা বৌদ্ধবিহার এবং ১১৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ত্সুরফু বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হয়। [১১]:৩৭

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. He gave to each of his sons a separate kingdom, viz., to the eldest Dpal-gyi-ngon, Maryul of Mnah-ris, the inhabitants using black bows; ru-thogs of the east and the Gold-mine of Hgog; nearer this way Lde-mchog-dkar-po; at the frontier ra-ba-dmar-po; Wam-le, to the top of the pass of the Yi-mig rock ...[৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Jens Schlieter। "Compassionate Killing or Conflict Resolution? The Murder of King Langdarma according to Tibetan Buddhist Sources"। University of Berne। 
  2. Yamaguchi, Zuiho. “The Fiction of King Dar ma's Persecution of Buddhism.” In Du Dunhuang au Japon: études chinoises et bouddhiques offertes à Michel Soymié, edited by Jean-Pierre Drège, 231–58. Geneva: Droz, 1996.
  3. Rolf Stein. Tibetan Civilization (1972) Stanford University Press. আইএসবিএন ০-৮০৪৭-০৯০১-৭
  4. Beckwith, Christopher I. The Tibetan Empire in Central Asia: A History of the Struggle for Great Power among Tibetans, Turks, Arabs, and Chinese during the Early Middle Ages (1987) Princeton University Press. আইএসবিএন ০-৬৯১-০২৪৬৯-৩
  5. Shakabpa, W. D. (২০১০)। One Hundred Thousand Moons: An Advanced Political History of Tibet1। Brill Publishers। আইএসবিএন 9789004177888 
  6. McKay, Alex (২০০৩)। Tibet and Her Neighbors: A History। Walther Konig। আইএসবিএন 3-88375-718-7 
  7. Petech, L. The Kingdom of Ladakh, (Serie Orientale Roma 51) Rome: Instituto Italiano per il Medio ed Estremo Oriente, 1977: 14-16
  8. Francke, A. H. (1914), 1920, 1926. Antiquities of Indian Tibet. Vol. 1: Personal Narrative; Vol. 2: The Chronicles of Ladak and Minor Chronicles, texts and translations, with Notes and Maps. Reprint: 1972. S. Chand & Co., New Delhi. (Google Books)
  9. van Schaik, Sam; Galambos, Imre (২০১১)। Manuscripts and Travellers: The Sino-Tibetan Documents of a Tenth-Century Buddhist Pilgrim। Walter de Gruyter। আইএসবিএন 9783110225655 
  10. Hoffman, Helmut, "Early and Medieval Tibet", in Sinor, David, ed., Cambridge History of Early Inner Asia, Cambridge: Cambridge University Press, 1990), 388, 394
  11. Grunfeld, A. Tom. The Making of Modern Tibet (1996) East Gate Book. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৫৬৩২৪-৭১৩-২