দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
জন্ম(১৮৭৭-০৪-১৫)১৫ এপ্রিল ১৮৭৭
উলাইল ঢাকা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ বাংলাদেশ)
মৃত্যু৩০ মার্চ ১৯৫৭(1957-03-30) (বয়স ৭৯)
কলকাতা, ভারত
পেশালেখক, সম্পাদক, রূপকথার লেখক, কথা সাহিত্য সংগ্রাহক, জমিদারি তত্ত্বাবধায়ক
ভাষাবাংলা
জাতীয়তাভারতীয়
ধরনকথাসাহিত্য, শিশু সাহিত্য
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৭)
ঠাকুরদাদার ঝুলি (১৯১০)
ঠানদিদির থলে(১৯১১)
দাম্পত্যসঙ্গীগিরিবালা দেবী
আত্মীয়রমদারঞ্জন মিত্র (পিতা) কুসুমকুমারী দেবী (মাতা) রাজলক্ষ্মী দেবী (পিসিমা)

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৫ এপ্রিল ১৮৭৭ - ৩০ মার্চ ১৯৫৭) ছিলেন বাংলার খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক ও লোককথার সংগ্রাহক, যাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রূপকথাগুলিকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা। সেগুলি মুখের কথার ধাঁচাতে হয়ে উঠেছে কথাসাহিত্যে তথা বাংলার সংস্কৃতিতে এক মূল্যবান সম্পদ।[১]

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল (১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ) বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার সাভার-এর কাছে উলাইল গ্রামে অভিজাত মিত্র মজুমদার পরিবারে রূপকথার এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার।

প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

প্রথমে মা কুসুমময়ী দেবীর কাছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে রূপকথার আনন্দের জগতের সন্ধান লাভ করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জগন্নাথ কলেজিয়েট স্কুলে ভরতি হন। এরপর পড়েন সন্তোষ জাহবী হাই স্কুল-এ। এখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত। পঁচিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম বই উত্থান কাব্য প্রকাশিত হয়। এর আগেই পিতার সঙ্গে কিছুদিন মুর্শিদাবাদে কাটানোর সময় সুধা মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) ঢাকা জেলার সাভার উপজেলায় উলাইল এলাকার কর্ণপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তার মাতার নাম কুসুমময়ী ও পিতার নাম রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার। ১৮৮৭ সালে দশ বছর বয়সে তাঁকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হয় ঢাকার কিশোরীমোহন উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে ১৮৯৩ সালে, কিশোরীমোহন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দক্ষিণারঞ্জণকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হয়। এ দুটি বিদ্যালয়ে থাকার সময় পড়ালেখায় ভালো করতে না পারায়, তার পিতা টাঙ্গাইলে বোন (দক্ষিণারঞ্জনের পিসী) রাজলক্ষ্মী চৌধুরানীর কাছে রেখে টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয়ের বোর্ডিং-এ থেকে তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। বিদ্যালয়ের অধ্যয়ন শেষে পিতার সঙ্গে ২১ বৎসর বয়সে মুর্শিদাবাদে গিয়ে সেখানে পাঁচ বছর বাস করেন। এরপর ১৮৯৮ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর হাইস্কুলে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর কৃষ্ণনাথ কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন।[৩] দক্ষিণারঞ্জনের বাবা রমদারঞ্জন ১৯০২ সালে মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিসিমা রাজলক্ষ্মীর কাছে টাঙ্গাইলে বসবাস শুরু করেছিলেন।

সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]

পিতার সাথে মুর্শিদাবাদে অবস্থানকালে 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা','প্রদীপ' প্রভৃতি পত্রিকাতে প্রবন্ধাবলি প্রকাশ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ময়মনসিংহে পিসিমার কাছে চলে যান এবং গ্রাম্যপ্রকৃতি ও জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে রূপকথার প্রায় হারিয়ে যাওয়া সম্পদটিকে তিনি পুনরুদ্ধার করেন। গীতিকথা, ব্রতকথা, রূপকথা ও রসকথার চতুর্বর্গে তিনি কাহিনিগুলিকে বিন্যস্ত করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। স্বদেশি যুগে পিসিমার অর্থসাহায্যে কলকাতায় তিনি একটি প্রেস খুলেছিলেন। এ ছাড়াও তিনি প্রদীপ, প্রকৃতি, ভারতী, সারথি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ‘ভট্টাচার্য এন্ড সন্স' থেকে ঠাকুরমার ঝুলি প্রকাশিত হয়। দীনেশচন্দ্রের কাছেই রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণারঞ্জনের কথা শোনেন এবং ঠাকুরমার ঝুলি গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্বদেশি গানের সংকলন যা বা আহুতি প্রকাশিত হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় নারীচরিত্রের মহিযাজ্ঞাপক গ্রন্থ আর্থনারী (২ খণ্ড) এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মচিন্তা বিষয়ক শিশুপাঠ্য গ্রন্থ সচিত্র সরল চন্ডীপ্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত তোষণী পত্রিকায় তাঁর লেখা চারু ও হারু নামক কিশোর উপন্যাসটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয়। শিশু-কিশোরদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি অজস্র কবিতা, গল্প, জীবনী রচনা করেন। ১৯৩০-৩৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণারঞ্জন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি এই সংস্থার মুখপত্র পথ-এর প্রদর্শক সম্পাদকও ছিলেন। এই কাজে তাঁর বিজ্ঞানচেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সমিতি'র কার্যকরী সভাপতি ও পরিভাষা রচয়িতার দায়িত্ব তিনি পালন করেন। ঢাকা বান্ধবসমাজ তাঁকে ‘কাব্যানন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি কলিকাতা সাহিত্য সম্মেলনে ‘বাণীরঞ্জন’ উপাধি, শিশুসাহিত্য পরিষদের ‘ভুবনেশ্বরী পদক' লাভ করেন। লোকসংস্কৃতি পরিষদ, সব পেয়েছির আসর, নন্দন, সাহিত্যতীর্থ প্রভৃতি সংস্থা তাঁকে সম্মানিত করে পরে যখন পিসেমশায়ের জমিদারির ভারপ্রাপ্ত হয়ে ময়মনসিংহে থাকতে শুরু করেন সেই সময় দশ বছর ধরে বাংলার লুপ্তপ্রায় কথাসাহিত্যের সংগ্রহ ও গবেষণা করেন। পরে এই সংগৃহীত উপাদানসমূহ ও ড. দীনেশচন্দ্র সেনের উপদেশনুযায়ী রূপকথা, গীতিকার, রসকথা ও ব্রতকথা - এই চারভাগে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গের পল্লি-অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় বিপুল কথাসাহিত্যকে 'ঠাকুরমার ঝুলি','ঠাকুরদাদার ঝুলি','দাদামশায়ের থলে','ঠানদিদির থলে' প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে স্থায়ী রূপদান করেছেন। ১৯০১ সালে দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদিত মাসিক ‘সুধা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার প্রথম গ্রন্থ ‘উত্থান’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। নিজের বইয়ের ছবি এবং প্রচ্ছদগুলো সব সময় তিনি নিজেই আঁকতেন। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন অসাধারণ দারুশিল্পীও। কাঠের শিল্পকর্মে পটু ছিলেন।[৩] তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ-সভাপতি ও উক্ত পরিষদের মুখপত্র 'পথ'-এর সম্পাদক ছিলেন এবং পরিষদের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা-সমিতির সভাপতিরূপে বাংলায় বিজ্ঞানের বহু পরিভাষা রচনা করেন।[৪]

উল্লেখযোগ্য সাহিত্য[সম্পাদনা]

  • ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৭ সাল)
  • ঠাকুরদাদার ঝুলি (১৯০৯ সাল)
  • ঠানদিদির থলে (১৯০৯ সাল )
  • দাদামশায়ের থলে (১৯১৩ সাল)
  • খোকাবাবুর খেলা
  • আমাল বই
  • চারু ও হারু
  • ফার্স্ট বয় (১৯২৭ সাল)
  • লাস্ট বয়
  • বাংলার ব্রতকথা
  • সবুজ লেখা
  • আমার দেশ[৫]
  • সরল চন্ডী (১৯১৭),
  • পুবার কথা (১৯১৮)
  • উৎপল ও রবি (১৯২৮),
  • কিশোরদের মন (১৯৩৩),
  • কর্মের মূর্তি (১৯৩৩),
  • বাংলার সোনার ছেলে (১৯৩৫),
  • সবুজ লেখা (১৯৩৮),
  • পৃথিবীর রূপকথা (অনুবাদ গ্রন্থ)
  • চিরদিনের রূপকথা (১৯৪৭),
  • আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী (১৯৪৮)

Animation

চলচ্চিত্র[সম্পাদনা]

  • তার 'সাত ভাই চম্পা' গল্প অনুসারে ১৯৭৮ সালে চিত্রসাথী পরিচালিত ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র 'সাত ভাই চম্পা' মুক্তি পায়।
  • তার 'কিরণমালা' গল্প অনুসারে ১৯৭৯ সালে বরুন কাবাসি পরিচালিত ভারতীয় ফ্যান্টাসি ফিল্ম 'অরুণ বরুণ ও কিরণমালা' মুক্তি পায়।

ধারাবাহিক নাটক[সম্পাদনা]

  • তার 'কিরণমালা' গল্পের উপর ভিত্তি করে 'কিরণমালা' নামক ভারতীয় ফ্যান্টাসি টেলিভিশন সিরিজ নির্মিত হয়, যা ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল স্টার জলসায় প্রচারিত হয়।
  • তার গল্পের উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে নীতীশ রায় পরিচালিত ভারতীয় ফ্যান্টাসি ড্রামা ফিল্ম 'বুদ্ধু ভুতুম' নির্মিত হয়।
  • তার 'সাত ভাই চম্পা' গল্প অনুসারে একটি ভারতীয় বাংলা ভাষার ফ্যান্টাসি টেলিভিশন সিরিজ 'সাত ভাই চম্পা' নির্মিত হয়, যা জি বাংলায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রচারিত হয়। এতে মুখ‍্য চরিত্রে অভিনয় করেন প্রমিতা চক্রবর্তী , সুদীপ্তা ব‍্যানার্জী ও সোনালী চৌধুরী। সুরভীর সিস্টার নামে এটি হিন্দিতে ডাবিং করে বিগ ম‍্যাজিকে সম্প্রচারিত করা হয়।
  • ২০১৮ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি তার একই গল্প অনুসারে বাংলাদেশের প্রথম মেগা ধারাবাহিক 'সাত ভাই চম্পা' নির্মিত হয়, যা বাংলাদেশী টেলিভিশন চ্যানেল ' চ্যানেল আই' -তে সম্প্রচারিত হয়। এটির পরিচালক হলেন রিপন নাগ। ৫ মার্চ ২০১৯ সালে ১৪৫ তম পর্ব দিয়ে ধারাবাহিকটি সমাপ্ত করা হয়।
  • তার গল্পগ্রন্থ 'ঠাকুরমার ঝুলি' অনুসারে একটি ভারতীয় নৃতত্ত্ব টেলিভিশন সিরিজ 'ঠাকুমার ঝুলি নির্মিত হয় , যা ২০১৯ সালে স্টার জলসায় প্রচারিত হয়।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

তিনি বাংলা ১৩৬৩ সালের ১৬ই চৈত্র (১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে মার্চ) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। [৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. শিশিরকুমার দাশ (২০১৯)। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৯৫। আইএসবিএন 978-81-7955-007-9 
  2. Help for Disability and Distress (HDD) কর্তৃক প্রকাশিত বই : সাভার ডিরেক্টরি (সাভার উপজেলার তথ্য সংবলিত বই); প্রকাশকাল: ডিসেম্বর, ২০১২ ইং
  3. "লোকসাহিত্যের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১০ 
  4. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ২৮০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  5. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-১৮৮, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৩৫৪-৬