জাতিস্মর (চলচ্চিত্র)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জাতিস্মর
জাতিস্মর
পরিচালকসৃজিত মুখোপাধ্যায়
প্রযোজকরিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট[১]
রচয়িতাসৃজিত মুখোপাধ্যায়
শ্রেষ্ঠাংশেনিচে দেখুন
সুরকারকবীর সুমন
চিত্রগ্রাহকসৌমিক হালদার
সম্পাদকবোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মুক্তি
  • ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ (2014-01-17) (ভারত)
দেশভারত
ভাষাবাংলা

জাতিস্মর সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ২০১৪ সালের একটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় আছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (হেন্সম্যান অ্যান্টনি বা হেন্সম্যান ফিরিঙ্গি) নামের উনিশ শতকের একজন পর্তুগিজ কবিয়ালের ওপর নির্মিত। এতে ঊনিশ শতক ও বর্তমান সময় - এ দুই সময়ের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।[১] জাতিস্মর চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী কবীর সুমন

চলচ্চিত্রটি চারটি ৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র অ্যাওয়ার্ড-এ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।[২][৩][৪]

কাহিনী[সম্পাদনা]

বর্তমান সময়ে রোহিত (যীশু সেনগুপ্ত) গুজরাতে জন্মগ্রহণ করেন, কলকাতাতে বড় হন। তিনি মহামায়া (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়)-এর প্রেমে পড়ে যান এবং তার পাণিপ্রার্থনা করেন। যেহেতু সে মাত্র কয়েকটি বাংলা শব্দই জানে (এবং তা ভুল স্থানে ব্যবহার করে), মহামায়া তাকে এক কঠিন পরীক্ষা দেয়, একটি বাংলা গান সঠিকভাবে লিখে কোনপ্রকার ভাষাগত ভুল ছাড়াই তা গাইতে হবে। এতেই সে রাজি হবে বিয়ে করতে। রোহিত চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়তে পর্তুগাল যান।

দুই বছর কেটে যায়। এখন মহামায়া একটি জনপ্রিয় রেডিও স্টেশনের আরজে। রোহিত তখনও পর্তুগালে, কিন্তু মহামায়াকে আগের মতই ভালবাসে। তার বন্ধু ও সহপাঠী বোধি (আবীর চট্টোপাধ্যায়) এর সাহায্যে সে বাংলাকে সঠিকভাবে শিখছে। রোহিত সংগীতের কোর্স বেছে নেয় এবং ঊনিশ শতকের ফোককবি হেন্সম্যান অ্যান্টনির ওপর এক নিবন্ধ লিখবে বলে ঠিক করে। সে কলকাতায় যায় এবং সেখান থেকে ফরাসডাঙ্গা, চন্দননগরে, যেখানে অ্যান্টনি থাকতেন এবং গান নির্মাণ করতেন। বই সংগ্রহ করতে সে স্থানীয় লাইব্রেরীতে যায়। লাইব্রেরীয়ান কুশল হাজরা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) একজন অদ্ভুত মানুষ, যিনি নিজেকে অ্যান্টনির পুনর্জন্মকারী বলে দাবি করেন। কুশল বিলাপ করে বলে যে আগের জন্মের দৃশ্য তাকে হামেশাই তাড়া করে বেড়ায় এবং ধীরে ধীরে বর্তমান জীবনের স্মৃতি কেড়ে নিচ্ছে। রোহিত প্রতিজ্ঞা করে তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে এবং তার বদলে কুশলকে আগের জীবনের ইতিহাস বলতে হবে।

এরপর কাহিনী ঊনিশ শতকে চলে যায় যেখানে অ্যান্টনি তার সংগীত প্রতিভা দিয়ে গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করে দেয়। সে এক বাঙালি বিধবা, সৌদামিনীকে বাঁচায় যে 'সতীদাহ প্রথা'র বলি হতে যাচ্ছিল এবং পরবর্তীকে তাকে বিয়ে করেন। সে বাংলা ভাষা শেখার এবং এই ভাষায় গান লেখার প্রতিজ্ঞা করে। ঐ সময়ে কলকাতায় কবিগান খুব জনপ্রিয় ছিল যেখানে দুইজন কবিয়াল বা ফোককবি তাদের নিজ নিজ দল নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হবে এবং গান ও কবিতার মাধ্যমে একে অপরকে পরাজিত করতে চায়। অ্যান্টনি কবিগান-এর মাধ্যমে উৎসাহিত হত এবং নিজের এক দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজেই গান লিখতেন তার প্রথমবারে তিনি মহিলা কবিয়াল যোগেশ্বরী (অনন্যা চট্টোপাধ্যায়) এর বিপক্ষে দাঁড়ান এবং তাকে পরাজিত করেন। ধীরে ধীরে তিনি কবিয়াল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। তিনি ঐ সময়ের খ্যাতনামা কবিয়ালদের যেমন রাম বসু (নীল মুখোপাধ্যায়) এবং ঠাকুর সিংহ (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী), পরাজিত করেন।

একইসাথে বর্তমান সময়ে কুশলকে এক মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাকে ঐ দৃশ্য দেখা বন্ধ করতে বলা হয়। কিন্তু কুশলকে একটি কাজ করতে হবে যা অ্যান্টনি হিসেবে সে পারেনি। কুশলের দৃশ্য আরো শক্তিশালি হয়ে ওঠে। এরমধ্যে রোহিত তার নিজের সুরারোপিত সর্বশেষ বাংলা গান মহামায়ার সামনে গাইবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান কারণ মহামায়ার রেডিও স্টেশন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের শিল্পীদের এক বাংলা গানের প্রতিযোগিতা "বন্দেমোনিয়াম"-এর আয়োজন করে। বোধি, যে রোহিতকে দেখতে কলকাতায় এসে গানের আয়োজনের জন্য তাকে সিধু (নিজের চরিত্রেই) এর কাছে নিয়ে যান। এরমধ্যে মহামায়ার নিজের মধ্যে রোহিত-এর জন্য অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল।

কুশল রোহিতকে অ্যান্টনির শেষ কবিগান-এর গল্প বলে। অ্যান্টনি নিজের আয়োজনে এক দুর্গাপূজা করার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু গ্রামবাসী তা মেনে নেয়না কারণ সে একজন ফিরিঙ্গি এবং তার হিন্দুদের দুর্গাপূজা করার কোন অধিকার নেই। সে সৌদামিনীকে বলে যে সে আরেকটি কবিগান-এর জন্য কলকাতায় যাবে ও দুর্গাপূজার দিনগুলোতে থাকবে না। এইবারে প্রতিযোগিতাটি ছিল শ্রেষ্ঠ কবিয়াল ভোলা ময়রার (খরাজ মুখোপাধ্যায়) বিরুদ্ধে। কঠিন প্রতিযোগিতা হয় এবং অ্যান্টনি জয়লাভ করে।

এরমধ্যে বর্তমান সময়ে "বন্দেমোনিয়াম"-এর দিনক্ষণ এসে পড়ে। রোহিত স্টেজে উঠে এবং তার বাংলা গান "এ তুমি কেমন তুমি" গায়; মহামায়া কেঁদে ফেলে। গানটির চলাকালীনই চলচ্চিত্র উনিশ শতকে চলে যায়। ভোলা ময়রার বিরুদ্ধে জয়লাভের পর সে কলকাতায় এসে দেখতে পায় তার বাড়ি এবং দুর্গার প্রতিমা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে, সৌদামিনী মৃত এবং আশেপাশে কেউ নেই। তার ভালবাসার মৃত্যু ঘটে এবং বিশ্বাস চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সে তার স্ত্রীর জন্য এবং তার পাশে নিজের জন্যেও একটি কবর খোঁড়ে, কারণ একবার মজা করে স্ত্রীকে সে এই কথা দিয়েছিল।

এইন শো চলাকালীন বোধি কুশলকে রোহিতের পারফরম্যান্স দেখাতে অডিটোরিয়ামে নিয়ে যায়। কুশল ও মহামায়ার সাক্ষাৎ হয় এবং এর সাথে সাথেই সে চলে যায়। অনুষ্ঠানের পর রোহিত ও মহামায়া তাদের ভালবাসা স্বীকার করে নেয়। এর পরপরই রোহিত খবর পায় যে কুশল নিখোঁজ। সে মহামায়ার সাথে চন্দননগরে কুশলের বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে যে কুশল তার দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। সে রোহিতকে আক্রমণ করে এবং অর্থহীন কথা বলে। রোহিতের মন ভেঙে যায় কারণ সে বুঝতে পারে কুশল কোনপ্রকার চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। চলচ্চিত্রে এরপরে এক মস্ত ঘূর্ণি দেখা যায়। কারণ মহামায়া আসলে সৌদামিনীরই পুনর্জন্ম, কিন্তু মহামায়ার আগের জন্মের কোন কথাই মনে নেই। অ্যান্টনি তার স্ত্রীকে একা রেখে যাবার জন্য ক্ষমা চাইবে, যা সে মহামায়া ও রোহিত চলে যাবার পর করে। এরপর আগের জন্মের দৃশ্য আর তাকে তাড়া করে বেড়াবে না। চলচ্চিত্রটি কবীর সুমনের "জাতিস্মর" গান দিয়ে শেষ হয়।

অভিনয়ে[সম্পাদনা]

সংগীত[সম্পাদনা]

কবীর সুমন চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন এবং ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ছিলেন সহকারী সংগীত পরিচালক। এর অ্যালবামটি সমালোচক কর্তৃক এবং বাণিজ্যিকভাবেও সফল ছিল। চলচ্চিত্রের কবিগানগুলো অ্যালবামে ছিল। এর জাতিস্মর গানটি কবীর সুমনের নিজের অ্যালবাম জাতিস্মর (১৯৯৭) থেকে নেয়া হয়েছে। তবে গানটি অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও চলচ্চিত্রটির শেষের দিক দিয়ে নায়কের মনের অবস্থা বোঝাতে তা ব্যবহৃত হয়।

সংগীতের তালিকা[সম্পাদনা]

# শিরোনাম কণ্ঠশিল্পী
"জয় যোগেন্দ্র" শ্রীকান্ত আচার্য
"সহসা এলে কি" রূপঙ্কর বাগচী
"হলে যদি হলে সখা" শ্রমনা চক্রবর্তী
"যে শক্তি" শ্রীকান্ত আচার্য
"এ তুমি কেমন তুমি" রূপঙ্কর বাগচী
"চিন্তা নাই" খরাজ মুখোপাধ্যায়
"প্রেমে খান্ত হলাম প্রাণ" শ্রীকান্ত আচার্য
"ফাঁকা ফ্রেম" অনুপম রায়
"খ্রিস্টে আর কৃষ্টে" শ্রীকান্ত আচার্য
১০ "তুই জাত ফিরিঙ্গি" খরাজ মুখোপাধ্যায়
১১ "নো পুয়েডো (স্প্যানিশ ফোক সংগীত)" দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়
১২ "বলো হে অ্যান্টনি" কবীর সুমন
১৩ "এই বাংলায়" শ্রীকান্ত আচার্য
১৪ "সিংহ রাশি" সিদ্ধার্থ রায় (সিধু)
১৫ "এখন বুঝলি তুই" মনোময় ভট্টাচার্য্য
১৬ "প্রাণ তুমি আর" শ্রীকান্ত আচার্য
১৭ "বলো কোনটা প্রিয়" সাকি
১৮ "আগে যদি" সুমন মুখোপাধ্যায়
১৯ "জাত গেলো বলে" কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য
২০ "কি রঙ্গ তুই" শ্রীকান্ত আচার্য
২১ "এ তুমি কেমন তুমি" (রিপাইজ) সপ্তর্ষী মুখোপাধ্যায়
২২ "খোদার কসম জান" কবীর সুমন

গ্রহণ[সম্পাদনা]

১৭ই জানুয়ারি, ২০১৪ সালে ভারতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় এবং সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে। চলচ্চিত্রটিকে সৃজিত মুখোপাধ্যায়প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি বলা হয়ে থাকে।[৫][৬] ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য চলচ্চিত্রের বিশেষ স্ক্রিনিং হয় নিউ দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে[৭]

পুরস্কার[সম্পাদনা]

পুরস্কার বিভাগ বিজেতা
৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার[২] শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক কবীর সুমন
৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার[২] শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক ('এ তুমি কেমন তুমি' গানের জন্য) রূপঙ্কর বাগচী
৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার[২] শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জা সাবর্নী দাস
৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার[২] শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিকল্পনা বিক্রম গায়কোয়াড

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Srijit's Jaatishwar"The Telegraph। ৬ জুলাই ২০১৩। ১৮ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ নভেম্বর ২০১৩ 
  2. "জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে জাতিস্মরের জয়জয়কার"এবিপি আনন্দ। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৪ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "বাংলা ছবি 'জাতিস্মরের' জয়জয়কার"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৪ 
  4. "চার ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল 'জাতিস্মর'"দৈনিক কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৪ 
  5. Sen, Zinia (১৯ জানুয়ারি ২০১৪)। "Jaatishwar"The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৪ 
  6. "Prosenjit's 'Jaatishwar' is a nostalgic tribute to 19th century Bengal"। IBN Live। ২১ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৪ 
  7. "Prosenjit's 'Jaatishwar' screened for president"। Zee News। ১৭ জানুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৪ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]