কূর্মপুরাণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(কূর্ম পুরাণ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগরী লিপিতে লিখিত একটি কূর্মপুরাণ পুথি

কূর্মপুরাণ হল হিন্দুদের আঠারোটি মহাপুরাণের অন্যতম এবং একটি পুরাতন বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ।[১][২] গ্রন্থটি বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের নামাঙ্কিত।[৩][৪]

বর্তমানে কূর্মপুরাণের যে পুথিগুলি পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে অনেক পাঠান্তর লক্ষিত হয়।[৫][৬][৭] আঞ্চলিক পুথি অনুযায়ী এই পুরাণের অধ্যায়ের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সমালোচনামূলক সম্পাদনায় সমগ্র পুরাণটিকে ৯৫টি অধ্যায়ের বিভক্ত করা হয়েছে।[৮] অন্যদিকে হিন্দুদের প্রথাগত বিশ্বাস অনুযায়ী কূর্মপুরাণের শ্লোকসংখ্যা ১৭,০০০ হলেও প্রাপ্ত পুথিগুলিতে এই পুরাণের শ্লোকসংখ্যা প্রায় ৬,০০০।[৯]

লুডো রোচারের মতে ধর্মীয় ধারণার আলোচনার দিক থেকে এই পুরাণটি সমগ্র পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কৌতুহলোদ্দীপক। কারণ, বৈষ্ণব গ্রন্থ হলেও এই পুরাণে বিষ্ণু প্রধান দেবতা নন।[১০] বরং এই গ্রন্থে সমান ঐকান্তিকতায় বিষ্ণু, শিবশক্তির মাহাত্ম্য আলোচিত হয়েছে।[১০][১১] অন্যান্য পুরাণের মতো কূর্মপুরাণেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিংবদন্তি, পৌরাণিক কাহিনি, ভূগোল, তীর্থমাহাত্ম্য, ধর্মতত্ত্ব এবং একটি দার্শনিক গীতা। ঈশ্বরগীতা নামে পরিচিত এই গীতাটি এই পুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এতে ভগবদ্গীতার সমধর্মী বিভিন্ন বিষয় পরমেশ্বর শিবের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এই গীতা তে ব্যাসদেব স্বয়ং বলেছেন, নারায়ণ রূপী শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মহাদেবের এই জ্ঞানকেই প্রদান করেছিলেন।যা ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত।[১০][১২]

রচনাকাল[সম্পাদনা]

কূর্মপুরাণের মূল অংশটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত হয় এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে সমগ্র গ্রন্থটি বহুবার সংশোধিত হয়।[২] তবে এটি একটি ধারণা মাত্র। এর রচনা কাল মূলত আরো প্রাচীন।

সকল পুরাণের মতো কূর্মপুরাণের কালপঞ্জিও অত্যন্ত জটিল। ডিমিট ও ভ্যান বুইটেনেনের মতে, প্রত্যেকটি পুরাণের পুথিগুলি রচনাশৈলীর দিক থেকে বিশ্বকোষতুল্য এবং কবে, কোথায়, কেন এবং কে সেগুলি রচনা করেছিলেন তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য:[১৩]

অধুনা লভ্য পুরাণগুলি স্তর অনুযায়ী বিন্যস্ত সাহিত্য। শিরোনাম-যুক্ত প্রত্যেকটি রচনা আনুক্রমিক ঐতিহাসিক যুগগুলিতে অসংখ্য সংযোজনের মাধ্যমে বর্ধিত উপাদান-সমৃদ্ধ। এই কারণে কোনও পুরাণেরই একটি নির্দিষ্ট রচনাকাল নেই। (...) এগুলি দেখে মনে হয় যেন এগুলি এক-একটি গ্রন্থাগার যেখানে গ্রন্থের নতুন নতুন খণ্ড ক্রমাগত যুক্ত হয়ে চলেছিল। তবে এই সংযোজন বইয়ের তাকের শেষ প্রান্তে করা হয়নি, করা হয়েছিল এলোমেলোভাবে।[১৪]

— কর্নেলিয়া ডিমিট ও জে. এ. বি. ভ্যান বুইটেনেন, ক্ল্যাসিকাল হিন্দু মিথোলজি: আ রিডার ইন সংস্কৃত পুরাণস[১৩]

গঠনশৈলী[সম্পাদনা]

কূর্মপুরাণের অনেকগুলি পাঠান্তর পাওয়া যায়। তবে সকল পুথিতেই পুরাণটির দু’টি ভাগ দৃষ্ট হয় – "পূর্ববিভাগ" (আদি বিভাগ) ও "উপরিবিভাগ" (উর্ধ্ববিভাগ)।[৮] পুথি অনুযায়ী পুরাণটির অধ্যায় সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন।[৮] তবে বিভিন্ন পুথির সমালোচনামূলক সংস্করণে পূর্ববিভাগ ৫১টি এবং উপরিবিভাগ ৪১টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত।[৮]

পদ্মপুরাণে কূর্মপুরাণকে তামসিক পুরাণের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।[১৫] গবেষকদের মতে, পুরাণগুলির "সত্ত্ব-রজঃ-তমো" শ্রেণিবিভাগ "সম্পূর্ণ অলীক কল্পনা"। এই পুরাণের ক্ষেত্রেও এই জাতীয় শ্রেণিবিন্যাসের কোনও যথোপযুক্ত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।[১৬]

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

রোচারের মতে, কূর্মপুরাণ হল সর্বাপেক্ষা কৌতুহলোদ্দীপক সম্প্রদায়-কেন্দ্রিক পুরাণ। কারণ, বিষ্ণুর একটি অবতারের নামাঙ্কিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এই পুরাণটি বিষ্ণু ও শিব-কেন্দ্রিক কিংবদন্তি, পৌরাণিক কাহিনি, তীর্থমাহাত্ম্য ও ধর্মতত্ত্বের সংকলন।[১০] এই পুরাণে প্রাপ্ত উপাখ্যানগুলি অন্যান্য পুরাণ থেকে পাওয়া উপাখ্যানগুলিরই অনুরূপ। কিন্তু এই পুরাণে বিষ্ণু বা শিব কেউই প্রধান দেবতা নন।[১০] এই গ্রন্থে মধ্যযুগীয় বারাণসীর একটি পর্যটন-সহায়িকা পাওয়া গেলেও তা মূলত শৈব তীর্থক্ষেত্র-কেন্দ্রিক। অন্যদিকে পঞ্চরাত্র কাহিনিগুলিতে বিষ্ণুর প্রাধান্য লক্ষিত হলেও সেখানে শ্রীকে মহাশক্তি তথা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র সহ সকল দেবতার শক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।[১০]

অন্যান্য পুরাণগুলির মতো কূর্মপুরাণেও একটি দার্শনিক গীতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।[১০] এটির নাম ঈশ্বরগীতা। এগারোটি অধ্যায়বিশিষ্ট এই গীতাটি প্রকৃতপক্ষে শিবের মাধ্যমে কথিত ভগবদ্গীতার একটি রূপান্তর।[১০] এই এগারো অধ্যায়ে কূর্মপুরাণের উপরিবিভাগের অন্তর্গত।[১২]

ঈশ্বরগীতা গ্রন্থাংশে উল্লিখিত ধারণাগুলি ভগবদ্গীতা এবং কঠোপনিষদ্‌শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্‌ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে গৃহীত ও উদ্ধৃত হয়েছে।[১০] ভগবদ্গীতার মতো এই গ্রন্থেও যোগতত্ত্ব ও ব্রত আলোচিত হয়েছে; তবে এখানে কথক হলেন স্বয়ং শিব। গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, বিষ্ণু ও শিব পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। তারপর বিষ্ণু শিবকে সংসারের প্রকৃতি, জীবন ও আত্মতত্ত্ব বর্ণনা করতে বললেন। উত্তরে পরমাত্মা শিব আত্মা, ব্রহ্ম-পুরুষ, প্রকৃতি, মায়া, যোগমোক্ষের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেন।[২] রোচারের মতে, এই দর্শনের ভিত্তি অদ্বৈতবাদী ধ্যানধারণা, যেখানে জীবাত্মার সঙ্গে পরব্রহ্মের একত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[২] এই গ্রন্থের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হল, ভক্তিযোগের মাধ্যমে বর্ণ-নির্বিশেষে সকলেই মুক্তিলাভে সক্ষম।[২]

নারদপুরাণে (এক। ১০৬। ১-২২) অন্যান্য পুরাণের সারসংক্ষেপের সঙ্গে সংক্ষেপে কূর্মপুরাণের অংশগুলিও বর্ণিত হয়েছে।[১৭]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Dalal 2014, পৃ. 460।
  2. Rocher 1986, পৃ. 186।
  3. Dimmitt ও van Buitenen 2012, পৃ. 63, 74।
  4. Bryant 2007, পৃ. 18 note 25।
  5. Rocher 1986, পৃ. 18, 184-186।
  6. Wilson 1864, পৃ. xxxiv-xxxv।
  7. Gregory Bailey (২০০৩)। Arvind Sharma, সম্পাদক। The Study of Hinduism। University of South Carolina Press। পৃষ্ঠা 141–142। আইএসবিএন 978-1-57003-449-7 
  8. Rocher 1986, পৃ. 184।
  9. K P Gietz 1992, পৃ. 500 with note 2778।
  10. Rocher 1986, পৃ. 185।
  11. K P Gietz 1992, পৃ. 903 with note 5221।
  12. Nicholson, Andrew J. (২০১৪)। Lord Śiva's Song: The Īśvara Gītā। State University of New York Press। পৃষ্ঠা 3। 
  13. Dimmitt ও van Buitenen 2012, পৃ. 5।
  14. উদ্ধৃতি: As they exist today, the Puranas are a stratified literature. Each titled work consists of material that has grown by numerous accretions in successive historical eras. Thus no Purana has a single date of composition. (...) It is as if they were libraries to which new volumes have been continuously added, not necessarily at the end of the shelf, but randomly.
  15. Wilson 1864, পৃ. xii।
  16. Rocher 1986, পৃ. 21।
  17. Hazra, R.C. (1962). The Puranas in S. Radhakrishnan ed. The Cultural Heritage of India, Vol.II, Calcutta: Ramakrishna Mission Institute of Culture, আইএসবিএন ৮১-৮৫৮৪৩-০৩-১, p.259

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Mani, Vettam. Puranic Encyclopedia. 1st English ed. New Delhi: Motilal Banarsidass, 1975.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]