কালাপাহাড়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কালাপাহাড়
জন্ম নামরাজু
জন্ম১৬ শতক
বাংলা সালতানাত
মৃত্যু২৪ এপ্রিল ১৫৮৩
সুবাহ বাংলা, মুঘল সাম্রাজ্য
আনুগত্যসুলায়মান খান কররানী
দাউদ খান কররানী
যুদ্ধ/সংগ্রামরাজমহলের যুদ্ধ

কালাপাহাড় (১৫৩৪-১৫৮০) ছিলেন কররানী রাজবংশের এক দুর্ধর্ষ সিপাহসালার।[১] তার বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের নওগাঁ (নিয়ামতপুর ) বীরজাওন গ্রামে। তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। সুলায়মান খান কররানী যখন গৌড়ের শাসক সেসময় তিনি গৌড়ের সেনানীতে যোগদান করেন।[২]

ধর্মান্তর[সম্পাদনা]

তাঁর আসল নাম রাজীবলোচন রায় মতান্তরে কালাচাঁদ রায় (বা রায় ভাদুড়ী বা রাজচন্দ্র বা রাজকৃষ্ণ বা রাজনারায়ণ[৩]),ডাকনাম রাজু।[২] তিনি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন, পিতার নাম ছিল নয়ানচাঁদ রায় (ইনি গৌড় বাদশাহের ফৌজদার ছিলেন)। নিয়মিত বিষ্ণু পূজা করতেন। নবাব সুলায়মান খান কররানীর কন্যা দুলারি বিবি তার প্রণয়ে পড়লে ইসলাম ধর্ম অনুসারে সুলায়মানের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং সুলায়মানের প্রধান সেনাপতির পদ অলংকৃত করেন, মুসলমান কন্যা বিবাহের সুবাদে বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। আর সেই কারণে প্রতিশোধ স্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে 'মহম্মদ ফর্ম্মুলি' নাম ধারণ করেন।[৪][৫][৬] আর তখন থেকেই কালাপাহাড় নামে পরিচিত হন।[৭] ১৫৬৮ সালে তিনি পুরীর শ্রী শ্রী জগন্নাথ ধাম আক্রমণ করেন এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন।[৮][৯]

কালাপাহাড়ের সমরাভিযান[সম্পাদনা]

১৫৬৪-১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সাতগাঁও বন্দর অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সেই অবসরে সুলায়মান খান কররানী উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলায়মান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্য সংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান। এইসময় মুকুন্দদেব তাঁরই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন; এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোট রায় উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন।[১০]
কোচরাজ নরনারায়ণ, সুলায়মান খান কররানীর রাজত্বকালে গৌড় রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু কালাপাহাড় একাধারে রাজা নরনারায়ণের ভাই এবং সেনাপতি শুক্লধ্বজকে পরাজিত করে আসামের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন। এইসময়ে কামাখ্যা ও হাজোর প্রাচীন মন্দির গুলিতে কালাপাহাড় নির্বিচারে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন।[১১] মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে কালাপাহাড় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেন এবং অনুমান করা হয় তিনি এই যুদ্ধে নিহত হন (এপ্রিল ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) ।

মন্দির ধ্বংসকারী কালাপাহাড়[সম্পাদনা]

মুসলিম কন্যা বিবাহের কারণে কালাপাহাড় সমাজচ্যুত হন। মায়ের অনুরোধে কিছুদিন পর তিনি বাংলার হিন্দু ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তাঁরা কোন বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাকে ও তার স্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তাঁর কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেন। এতে কালাপাহাড় মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাই উড়িষ্যা অভিযানকালে তিনি উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্ম স্থানের উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান। ১৫৬৭-১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালাপাহাড় উড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলী নদীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।[৮]

কালাপাহাড় উড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। কালা পাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘণ্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালাপাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালাপাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। একজন নারী গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের ছাউনিতে উপস্থিত হন। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করেন। পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালাপাহাড় সহ বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে অবশিষ্ট সৈন্য পালিয়ে যায়,মনে করা হয় দেবী সম্বলেশ্বরী গোয়ালিনী ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছিলেন।[১২][১৩] মন্দির ধ্বংসের ঘটনা উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কররাণীদের কোচবিহার আক্রমণ কালে কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড় কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কররাণীর আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযান গুলোতে অংশগ্রহণ করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন।[১৪]

কালাপাহাড়ের সমাধি[সম্পাদনা]

মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পর তাকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি কালাপাহাড়ের সহযোদ্ধাদের; [১৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Experts trace Kalapahad's footprints"www.telegraphindia.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-০৬ 
  2. এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমেদ (২০১২)। "সুলায়মান কররানী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  3. বাংলা সহিত্য। বাংলাদেশ: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,বাংলাদেশ। ২০১৭। পৃষ্ঠা ২৩১। 
  4. Behera, Mahendra Narayan (২০০৩)। Brownstudy on Heathenland: A Book on Indology (ইংরেজি ভাষায়)। University Press of America। আইএসবিএন 978-0-7618-2652-1 
  5. Donaldson, Thomas; Donaldson, Thomas E. (২০০৫)। Konark (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-567591-7 
  6. "Archaeological Survey of India"asi.nic.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৮ 
  7. বিশ্বনাথ ঘোষ (১৯৮৯)। আমার নাম কালাপাহাড়। কলকাতা: সাহিত্যশ্রী। পৃষ্ঠা ২২। 
  8. The Cult of Jagannātha By Kanhu Charan Mishra, Published 1971
  9. এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমেদ (২০১২)। "সুলায়মান কররানী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  10. Calcutta (১৯০১)। Journal Of The Asiatic Society Of Bengal 1901 Vol.lxix Part I। পৃষ্ঠা ১৮৯। 
  11. Gait, Edward (১৯০৬)। A History of Assam (ইংরেজি ভাষায়)। Thacker, Spink & Company। পৃষ্ঠা ৫২–৫৩। আইএসবিএন 978-0-404-16819-3 
  12. K.S. Behera, "Gloom and Bloom: The Case of Jagannatha Temples in Midnapore District"
  13. "10 interesting facts about kala Pahada"। ৮ নভেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুন ২০১৭ 
  14. ভারতকোষ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ , কলিকাতা, ১৯৬৬,পাতা-৩০২

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • ইতিহাস ও সংস্কৃতি", শ্রী শ্যামাপদ ভৌমিক, [প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৯]
  • “মেদিনীপুরের ইতিহাস”, কমল চৌধুরী সম্পাদিত, [দে'জ পাবলিশার্স, ২০১১]
  • K.S. Behera, "Gloom and Bloom: The Case of Jagannatha Temples in Midnapore District"