অ্যান্টার্কটিকার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অ্যান্টার্কটিকার ভূপ্রাকৃতিক মানচিত্র

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ভূতাত্ত্বিক প্রিক্যাম্ব্রিয়ান, প্যালিওজোয়িক, মেসোজোয়িক ও সেনোজোয়িক যুগ ধরে ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে।

পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস[সম্পাদনা]

যদিও পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার পঁচানব্বই শতাংশ অঞ্চল বরফের নিচে ঢাকা পড়ে আছে, তবুও বাকি পাঁচ শতাংশ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন পর্যালোচনা করে জানা গেছে যে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার অধিকাংশ অঞ্চল ৬০ কোটি বছর থেকে ৩৫০ কোটি বছরের প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শিলা দ্বারা গঠিত।

এখানকার অধিকাংশ অঞ্চল রূপান্তরিত শিলা, মিশ্র শিলা এবং গ্রানাইট দিয়ে তৈরী। অ্যান্টার্কটিকার এই অংশ ভূত্বকের গভীর অংশের শিলা দিয়ে তৈরী। গভীরাঞ্চলের উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে গ্র্যানুলাইট ফেশিসের রূপান্তরিত শিলা ও চার্নকাইট শিলা এবং অপেক্ষাকৃত কম তাপে রূপান্তরিত অ্যাম্ফিবোলাইট ফেশিস শিলা তৈরী হয়ে কালক্রমে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসে। পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার গ্র্যানুলাইট ফেশিস ও চার্নকাইট শিলাগুলির সাথে পূর্ব আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতের পাথরের সঙ্গে সাদৃশ্য এই মহাদেশীয় প্রবাহ তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখে যা বলে এক সময়ে এই অঞ্চলগুলি পরস্পর সংলগ্ন ছিল।[১]

ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস[সম্পাদনা]

এই পর্বতমালার ভূতাত্ত্বিক গঠন পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা থেকে ভিন্ন ও নবীন। প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শেষের দিকে ষাট কোটি বছর আগে এই অঞ্চলে প্রায় দশ কিলোমিটার পুরু পাললিক শিলার স্তর অবক্ষেপিত হয় যার বেশিরভাগ অংশ কাদাপাথর এবং গ্রেওয়াক নামক বেলেপাথর দিয়ে তৈরী। এর পর এখানে প্রবল অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পুরু লাভার স্তরে সব কিছু ঢাকা পড়ে যায়। তারপর পাথরগুলি প্রচন্ড ভাবে বলিত হয়ে বর্তমান ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালার সমান্তরালে এক ভঙ্গিল পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।

প্যালিওজোয়িক যুগের শুরুতে এই অঞ্চলের পাথরগুলি ক্ষয়ে যায় ও ভূপৃষ্ঠ অবনমিত হয়ে এক সমুদ্রের সৃষ্টি হয়, যার গভীর প্রদেশে চার কিলোমিটার পুরু চুনাপাথরের স্তর অবক্ষেপিত হয় এবং এর অগভীর অঞ্চলে চুনের সঙ্গে কিছু বালি ও কাদা অবক্ষেপিত হয়। এই শিলাসমষ্টিকে রস কমপ্লেক্স বলা হয়। এর পাথরগুলি ক্রমে বলিত হয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কোটি বছর আগে এক ভঙ্গিল পর্বতমালার সৃষ্টি করে। এই ঘটনাকে রস অরোজেনি বলা হয়।

প্রায় চল্লিশ কোটি বছর আগে রস রস অরোজেনিতে সৃষ্ট ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালা সম্পূরণভাবে ক্ষয়ে যায় ও আবার পলিস্তর আবক্ষেপণ শুরু হয়। প্রায় তিরিশ কোটি বছর আগে হিমযুগের আবির্ভাবে এই অঞ্চলে হিমবাহ সৃষ্টি হয়ে সমস্ত অঞ্চল বরফে ঢাকা পড়ে যায়। সেনোজোয়িক যুগে সমগ্র অঞ্চলটি উত্থিত হয়ে বর্তমান ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালার সৃষ্টি করেছে।[১]

পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস[সম্পাদনা]

অ্যান্টার্কটিকার সচেয়ে গতিশীল এবং নবীন অংশ পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা। এই অংশের শিলাবিরূপন ঘটে কুড়ি কোটি বছর আগে এবং প্রায় দশ কোটি বছর আগে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এই অঞ্চল্টি সৃষ্টি হয়। এরপর সমস্ত অঞ্চলটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। আড়াই কোটি বছর আগে অঞ্চলটি উত্থিত হয়ে বর্তমান মূল চেহারা নেয়।[১]

গণ্ডোয়ানার সঙ্গে সম্পর্ক[সম্পাদনা]

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার ভূবিজ্ঞানী আ্লেকজান্ডার দু তোয়া তার লেখা আওয়ার ওয়ান্ডারিং কন্টিনেন্টস বইতে আলফ্রেড ওয়েগণারের মহাদেশীয় প্রবাহ তত্ত্বের সমর্থন করে বলেন যে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভারত, অস্ট্রেলিয়াঅ্যান্টার্কটিকার পাথরগুলোর মধ্যে এমন একটা সামঞ্জস্য আছে যাতে বলা পারে যে এরা একসময়ে পরস্পরের সংলগ্ন থেকে এক অতিকায় মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয় গণ্ডোয়ানা[২]

তিরিশ কোটি বছর আগে প্যালিওজোয়িক যুগের শেষের দিকে উচ্চ কারবোনিফেরাস কালে হিমযুগ শুরু হলে হিমবাহের প্রবাহের ঘর্ষণের ফলে টিলাইট পাথর তৈরী হয়। দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভারতঅস্ট্রেলিয়ার সাথে সাথে ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালায় এই ধরনের শিলার উপস্থিতি হিমযুগের অস্তিত্ব এবং এই অঞ্চলগুলির নৈকট্যের প্রমাণ করে। ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালার টিলাইট স্তরের ওপরে অবস্থিত বিকন গ্রুপের শিলাস্তরে পারমিইয়ান যুগের প্রায় পচিশ কোটি বছর আগেকার পাথরে গ্লসপ্টেরিস নামে এক ধরনের উদ্ভিদ সমষ্টির জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যা ভারতেও পাওয়া গেছে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিক পর্বতমালায় সংগঠিত এক ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষায় ট্রায়াসিক যুগের লিস্ট্রসরাস নামে এক ধরনের সরীসৃপের হাড়ের জীবশ্ম পাওয়া যায় যার অস্তিত্ব দক্ষিণ আফ্রিকাভারতে ছিল। [১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. আন্টার্কটিকা - সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, আইএসবিএন ৮১-৭০৬৬-০৯১-২
  2. Our Wandering Continents, An Hypothesis of Continental Drifting - Alexander du Toit, Oliver & Boyd, London