অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অচ্যুতচরণ চৌধুরী
অঅচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রতাপগড় রাজ্যের সময়কার একটি পাথরের টুকরো পাশে বসে আছে, আনু. ১৯০০-এর দশক
অঅচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রতাপগড় রাজ্যের সময়কার একটি পাথরের টুকরো পাশে বসে আছে, আনু. ১৯০০-এর দশক
জন্ম(১৮৬৬-০২-০৫)৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৬
মৃত্যু২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩(1953-09-25) (বয়স ৮৭)
ভাষাবাংলা
ধরনসমূহঐতিহাসিক, তত্ত্ববিদ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিশ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত

অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি (১৮৬৫ – ১৯৫৩) ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের একজন ইতিহাসবিদ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের সুখ্যাত পণ্ডিত, যিনি বিশেষত সিলেটের বিস্তৃত ইতিহাস রচনার মাধ্যমে সমাদৃত হোন। ১৯২০ দশকে প্রকাশিত তাঁর ১,৬৬৩ পৃষ্ঠার "শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত" নামক বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থটি শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ)শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) নামে দুইটি আলাদা আলাদা খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল, যা আজও সিলেট ও প্রাচীন সিলেট অঞ্চলের (ভারতের করিমগঞ্জ অবধি বিস্তৃত) ইতিহাসের আলোচনায় অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ আকরগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন [ক]। এছাড়াও তিনি ফোকলোরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জীবনী রচনা করে গেছেন। তিনি ১৩৬০ বঙ্গাব্দের (১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) ১০ আশ্বিন ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১]

জীবনী[সম্পাদনা]

অচ্যুতচরণ চৌধুরী ১২৭২ বঙ্গাব্দের (১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) ২৩ মাঘ বিভাগপূর্ব তৎকালীন সিলেট বিভাগের করিমগঞ্জের (সেই সময় সিলেট জেলার অংশ ছিল) জফরগড় পরগনার মৈনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম অদ্বৈতচরণ চৌধুরী ও মাতা কোটিমণি চৌধুরী[২] পিতার মাধ্যমে, তিনি জফরগড়ের জমিদারদের বংশধর ছিলেন। [৩]

ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার সময়, তিনি নিজ আগ্রহে ইতিহাসধর্মশাস্ত্র শিখেন, বিশেষ করে সাহিত্যবৈষ্ণব তত্ত্বের বিশেষ মনোনিবেশ দেন। পরবর্তীকালে প্রাপ্ত বয়সে তিনি বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে বৃন্দাবন, ঢাকাদক্ষিণ প্রভৃতি তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন এবং ঢাকা দক্ষিণে নিজ ব্যয়ে গৌরবিষ্ণুপ্রিয়া মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।[২]

পাথরকান্দিতে ভূ-সম্পত্তিতে কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ার আগে, ১৮৯৭ সালে তিনি সিলেটের গিরিশ মিডল ইংলিশ স্কুলে শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি শ্রীহট্ট দর্পণ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও মাত্র দুই বছর পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।[২]

এক দশক পরে, তিনি সিলেটের ইতিহাস নিয়ে একটি বিস্তৃত রচনার কাজ শুরু করেছিলেন, যার নাম দেন শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত। লেখাটি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশের পর তার এই কাজটি ব্যাপক প্রসংসিত হয়, সমকালীন ঐতিহাসিক আচার্য যদুনাথ সরকার এটিকে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আদর্শ বলে উল্লেখ করেন।[২]

তার সংগ্রহে ইতিহাসধর্ম সম্পর্কিত তিন হাজার বইপুঁথির সমন্বয়ে গঠিত বিস্তৃত ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল। তিনি বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব নিয়েও একাধিক বই লিখেছিলেন।[২]

সৃষ্টিকর্ম[সম্পাদনা]

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত[সম্পাদনা]

১,৬৬৩ পৃষ্ঠার এই ইতিহাস গ্রন্থটি দুইটি আলাদা আলাদা খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ) (৭৭৯ পৃষ্ঠা) প্রকাশিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) (৮৮৪) প্রকাশিত হয় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে (১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ)। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য কামরূপ শাসনাবলীর গ্রন্থকার পণ্ডিত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য তৎকালীন মূল্যমানের সাড়ে চার হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। প্রকাশিত গ্রন্থটি সম্পর্কে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আবদুল হক চৌধুরীর অভিমত:

[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এই বৃহৎ বইটিতে তিনি সিলেটের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক বিবরণ ছাড়াও প্রতিটি গ্রামের প্রাচীন হিন্দু-মুসলমান পরিবারগুলোর ইতিহাস, কবি, রাজনীতিবিদ, ফকির-দরবেশ, সাধু, আওলিয়াদের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে গেছেন। এছাড়া দিয়েছেন বহু ঐতিহাসিক সনদ, প্রাচীন মুদ্রা ও ফরমানের আলোকচিত্র, বংশলতিকার অনুলিপি ও প্রাচীন মুদ্রার ছবি। এই ইতিহাস গ্রন্থ রচনার জন্য অচ্যুতচরণ চৌধুরী ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেটের প্রতিটি গ্রামে, সেই যুগে, যে যুগে পর্যাপ্ত যানবাহন ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট। এমনকি বইয়ের "উত্তরাংশ" মুদ্রণ উপলক্ষে তিনি রুগ্ন স্ত্রী ও আট মাসের শিশু সন্তানকে ফেলে কলকাতা চলে যান, আর তাঁর অবর্তমানে সেই রুগ্ন স্ত্রী চিকিৎসার অভাবে মারা যান, পরে আট মাসের শিশুটিও মারা যায়। তাঁর বিপুল ত্যাগের এই কীর্তি সিলেটের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসেবে আজও সমাদৃত। যদিও ঐতিহাসিক সৈয়দ মুর্তাজা আলী গ্রন্থটির সমালোচনায় বলেন:

[৪]

মূল গ্রন্থ দুটির প্রকাশক ছিলেন কলকাতার শ্রী উপেন্দ্র নাথ পাল চৌধুরী, আর মূল্য ছিল যথাক্রমে তৎকালীন মূল্যমানে চার টাকা ও পাঁচ টাকা।[১] বইটি দীর্ঘদিন আর পুণর্মুদ্রিত না হলেও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের উৎস প্রকাশন তা পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগ নেয়, যদিও তাতে কোনো সংশোধন না এনে মূলানুগ রাখা হয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এছাড়াও কলকাতা থেকেও বইটির দুটি খণ্ড পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।[৫]

অন্যান্য[সম্পাদনা]

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ছাড়াও তাঁর ছিল কমপক্ষে আরো ২০টি প্রকাশনা:[১]

  • চৈতন্য চরিত (১৩১১ বঙ্গাব্দ)
  • রঘূনাথ দাস গোস্বামীর জীবনী (১৩০০ বঙ্গাব্দ)
  • গোপাল ভট্ট গোস্বামীর জীবনী (১৩০২ বঙ্গাব্দ)
  • নিতাই লীলা লহরী (১৩২০ বঙ্গাব্দ)
  • হরিদাস ঠাকুরের জীবনী (১৩০৩ বঙ্গাব্দ)
  • সীতা চরিত
  • ভক্ত নির্য্যাস (১২৯৯ বঙ্গাব্দ)
  • সাধু চরিত (১৩১৯ বঙ্গাব্দ)
  • চারু চরিত
  • শ্যামানন্দ চরিত
  • শ্রী গৌরাঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভ্রমণ (১৩০৯ বঙ্গাব্দ)
  • চাঁদ সওদাগর
  • বিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহ
  • লাউড়িয়া কৃষদাস রচিত বাল্যলীলা সূত্রম বঙ্গানুবাদ
  • সাবাস ছবি (১৩১০ বঙ্গাব্দ)
  • অশ্রু কণা
  • শান্তি লতা
  • বিষাদিতা
  • রাজভক্তি ও মহাযুদ্ধ
  • শ্রী পাদ ঈশ্বরপুরী

তিনি সিলেট থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা মাসিক শ্রীহট্ট দর্পন সম্পাদনা করতেন; আরো সম্পাদনা করতেন ‘কমলা’ নামের একটি সাহিত্যপত্রও[৬]। তাছাড়াও বিশিষ্ট গবেষণাধর্মী পত্রিকা সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় গবেষণাধর্মী লেখালেখি করতেন।[৭]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. ^ অনেক ইতিহাসবিদ ও লেখক শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উভয় খণ্ড) সিলেটের ইতিহাস পর্যালোচনায় ব্যবহার করেছেন, তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো: চট্টগ্রামের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী তাঁর সিলেট বিষয়ক ইতিহাস গ্রন্থ সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ[১] বইতে সিলেটি সংস্কৃতি, প্রথা ও লোক-উৎসব এবং আঞ্চলিক ব্যক্তিত্বের জীবনী আলোচনায়, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত মোহাম্মদ সাদিক-এর সিলেটি নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল[৮] বইতে নাগরি ভাষা ও সাহিত্য আলোচনায়, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা সম্পাদিত ছিলটে প্রচলিত পই-প্রবাদ ডাক-ডিঠান[৯] বইয়ের প্রারম্ভে সিলেটের ইতিহাস আলোচনায় শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য সিলেটের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ মুর্তাজা আলী তাঁর বই হজরত শাহ জালাল ও সিলেটের ইতিহাস বইতে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ব্যবহার করার সময় এবিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, বইটিতে সময়ের ব্যবধানে সংশোধন করা জরুরি এবং বইতে সিলেটের মুসলমান সমাজ সম্পর্কে সম্যক আলোচনা অনুপস্থিত। এছাড়াও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান[১০] প্রণয়নে চট্টগ্রামের সংকলক ও সম্পাদক আহমেদ আমিন চৌধুরী শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত থেকে অনেক শব্দ ধার করেছেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ, আবদুল হক চৌধুরী; কথামালা প্রকাশনা, চট্টগ্রাম থেকে মুদ্রিত: জুলাই ১৯৯৩; পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১২, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  2. নন্দলাল শর্মা (২০১২)। "চৌধুরী, অচ্যুৎচরণ"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  3. চৌধুরি, সুজিত (১৯৬০)। The Mutiny Period in Cachar। ঠাকুর সোসাইটি। পৃষ্ঠা 53 
  4. হজরত শাহ্‌ জালাল ও সিলেটের ইতিহাস, সৈয়দ মুর্তাজা আলী; উৎস প্রকাশন, ঢাকা থেকে পুণর্মুদ্রিত: জুলাই ২০০৩। পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১২, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  5. পুস্তক পরিচয় ২... ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা। পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১২, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  6. বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ জুন ২০১১ তারিখে, সিলেট জেলা তথ্য বাতায়ন। পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১২, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  7. সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ আগস্ট ২০১১ তারিখে, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী; বাংলাপিডিয়া (সিডি ভার্ষণ: 2.0.0), ঢাকা থেকে পুনর্মুদ্রিত: ২০০৬। পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১২, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  8. সিলেটি নাগরী:ফকিরি ধারার ফসল, মোহাম্মদ সাদিক; বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা; ডিসেম্বর ২০০৮; ISBN 984-300-003029-0। পরিদর্শনের তারিখ: ১৩ জুন ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  9. নামোৎপত্তি প্রসঙ্গ: ছিলটে প্রচলিত পই-প্রবাদ ডাক-ডিঠান, সংগ্রহ ও সংকলন: আম্বিয়া খাতুন, সম্পাদনা: দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা; বাংলা একাডেমী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত: জুন ১৯৯৮; আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৩৮১১-৯; পৃ. ২৮। পরিদর্শনের তারিখ: জুন ১৩, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  10. পরিশিষ্ট ৯: সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, সংকলন, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা: আহমেদ আমীন চৌধুরী; উৎস প্রকাশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত; নভেম্বর ২০০৯; পৃ. ১১৮; পরিদর্শনের তারিখ: ১৩ জুন ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]